আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এর ফলে উপমহাদেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিজয়ী গ্রিকদের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও চিন্তাভাবনার সাথে পরিচিত হয়ে ওঠার সুযোগ পায়। উত্তর-পশ্চিম উপমহাদেশ ও মগধের সাথে রেশম, মশলা ও সোনাকে কেন্দ্র করে গ্রিক তথা ইউরোপের বাণিজ্যের বিকাশ ঘটে।[১] শিল্প, সংস্কৃতি, লিখন-পদ্ধতি, শাসন ব্যবস্থা, যুদ্ধরীতি, প্রভৃতি নানা বিষয়ে এই অভিযানের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।
পারস্য বিজয়ের পর শুরু হয় ম্যাসিডনের তরুণ রাজা আলেকজান্ডারের ভারত আগ্রাসন। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩১ অব্দে তিনি পারস্য সাম্রাজ্য আক্রমণ করেন।[১] ও সে দেশ বিজয় সম্পূর্ণ করে সাম্রাজ্যের পূর্বদিকে অগ্রসর হন[২]। সে সময় সিন্ধু নদ অর্থাৎ ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিম সীমান্ত পর্যন্ত পারস্য সাম্রাজ্যের সীমানা বিস্তৃত ছিল।
৩৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আরিয়া (হিরাট) দখল করে আলেকজান্ডার বর্তমান আফগানিস্তানে পদার্পণ করেন। এরপর তিনি দক্ষিণে ঝারাঙ্গিয়া (সেস্তান) অভিমুখে অগ্রসর হন। একে একে হেলমন্দ উপত্যকা ও আরাকোশিয়া (আর্ঘান্দাব উপত্যকা) তাঁর দখলে এলে তিনি সেখান থেকে একটি বৃত্তাকার কিন্তু সহজ পথ অনুসরণ করে কাবুল উপত্যকায় উপস্থিত হন। এখানে বেগরামে তিনি নিজ নামাঙ্কিত একটি শহরেরও প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর হিন্দুকুশ পর্বতমালা অতিক্রম করে তিনি ব্যাকট্রিয়া (বলখ) অভিমুখে অগ্রসর হলে সেখানকার শাসক বেসাস সংঘর্ষ এড়িয়ে পিছু হটতে থাকলে তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করে আলেকজান্ডার সমগ্র ট্রান্স-অক্সেনিয়া তাঁর দখলে নিয়ে আসেন।[২] এই জয় সম্পন্ন করে ফিরে আসার পথে পুনরায় হিন্দুকুশ অতিক্রম করার সময় ৩২৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পরবর্তীকালে বৌদ্ধ সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসাবে গড়ে ওঠা মনোরম বামিয়ান উপত্যকায় যতদূর সম্ভব তাঁর পদার্পণ ঘটে। যদিও এ' সম্বন্ধে কোনও প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় না।[৩]
এইভাবে *সমগ্র মধ্য এশিয়া তাঁর পদানত হলে তিনি তাঁর নব অধিকৃত সাম্রাজ্যের শাসন বিন্যাসের পিছনে কিছু সময় ব্যয় করেন।* ধ্বংসপ্রাপ্ত আকামেনিদীয় সাম্রাজ্যের সামগ্রিক কাঠামো তিনি প্রায় অবিকল গ্রহণ করেন। এমনকী রাজকীয় উপাধি ও বিবিধ প্রথাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বজায় থাকে। প্রাদেশিক শাসকের পারসিক উপাধি খত্রপ গ্রিক উচ্চারণে সত্রপ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে, কিন্তু প্রাদেশিক প্রশাসনের পূর্ব কাঠামো মোটামুটি অক্ষুণ্ণই থাকে। শাসনকার্যের উচ্চপদে সাধারণভাবে ম্যাসিডোনিয় বা গ্রিকদের নিয়োগ করা হলেও পারসিক অভিজাতদের মধ্য থেকেও কিছুজনকে এই কাজে নিয়োগ করা হয়। ম্যাসিডোনিয়া ও গ্রিস থেকে নতুন সেনাপ্রবাহ অব্যাহত থাকলেও এইসময় থেকে আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন পারসিক জাতিগোষ্ঠীর সৈন্য ও সেনাপ্রধানদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এমনকী উত্তর-অক্সাস থেকে আগত অর্ধ-যাযাবর শক অশ্বারোহীরাও এই সময় তাঁর বাহিনীতে যোগ দেয়।[২] কিন্তু আলেকজান্ডারের কৃতিত্ব ছিল এই বহুজাতিক নবনিযুক্ত সৈন্যদেরও অতি দ্রুত গ্রিক ও ম্যাসিডোনিয় যুদ্ধপদ্ধতিতে শিক্ষিত করে তুলে নিজবাহিনীকে নবগঠিত করে তোলার প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন করা।
আলেকজান্ডারের ভারতবর্ষ আক্রমণের প্রাক্কালে উত্তর-পশ্চিম ভারত পরস্পরবিরোধী অনেকগুলো রাজ্যে বিভক্ত ছিল। তাদের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বহিরাক্রমণ ঠেকানো সম্ভবপর ছিল না। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৮ অব্দের মধ্যে সমগ্র পারস্য এবং আফগানিস্তান আলেকজান্ডারের দখলে এলে তিনি আরও পূর্বে অবস্থিত দেশগুলির দিকে নজর ফেরান। ৩২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দের বসন্তকালে তিনি হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে আরও পূর্বে অগ্রসর হন। কাবুল নদীর (কোফেন) তীর বরাবর এগিয়ে এসে তাঁর বাহিনী প্রথমে বর্তমান পেশোয়ার নগরীর উত্তরে অবস্থিত পিউসেলাওটিস (চারসাদ্দা?) ধ্বংস করে। এরপর সম্ভবত তাঁর বাহিনীর বামপ্রান্তকে সুরক্ষিত করার উদ্দেশ্যেই তিনি সোয়াট উপত্যকা অভিমুখে অগ্রসর হন ও এই অঞ্চলের বিভিন্ন জাতির মানুষকে দাসত্বশৃঙ্খলে আবদ্ধ করেন। এর ফলে এই অঞ্চলের প্রচূর গবাদি পশুও তাঁর দখলে আসে। এই অঞ্চলের আসাকেনীয় জাতিগোষ্ঠী তাঁর বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এদের প্রধান আসাকেনুস (সম্ভবত গোষ্ঠীর নামানুসারেই তিনি গ্রিক দলিলে এই নামে উল্লিখিত হয়েছেন) শেষপর্যন্ত তাঁর রাজধানী মাসাগা শহরে (এখনও পর্যন্ত এই শহরটির সঠিক অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি) অবরুদ্ধ হয়ে পড়লে আলেকজান্ডারের রণকৌশলের সামনে তাঁকে হার স্বীকার করতে হয়। এরপর আওর্নাস (বর্ণ?) নামক একটি পাহাড় যতদূর সম্ভব নেহাৎ অ্যাডভেঞ্চারের মেজাজেই দখল করা হয়।[২]
এরপর নিসা (গ্রিক দেবতা দিওদেনুসের নামানুসারেই এই শহরের নামকরণ বলে দাবি করা হয়ে থাকে) শহর আত্মসমর্পণ করলে আলেকজান্ডার সম্ভবত নৌকাসেতুর সাহায্যে সিন্ধু নদ পার হয়ে খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে ভারত ভূখণ্ডে পদার্পণ করেন।[২] এই সময় তিনি পূর্বতন আকামেনিদীয় সাম্রাজ্যের গান্ধার সত্রপির (প্রদেশের) অধীন ও সংলগ্ন সমস্ত রাজা ও গোষ্ঠীপ্রধানদের তাঁর কাছে বশ্যতা স্বীকার করার জন্য আহ্বান জানালে তক্ষশীলার রাজা অম্ভি (গ্রিক উচ্চারণে অমফিস) তাঁর নিকট স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু সবাই তাঁর এ' আহ্বান বিনা প্রতিরোধে মেনে নেয়নি। ফলে তিনি এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান শুরু করেন। আলেকজান্ডার পুষ্কলাবতীর রাজা অষ্টককে পরাভূত করেন, অশ্বক জাতিও তার নিকট পরাভূত হয়। ঝিলাম রাজ পুরু বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন এবং সর্বপ্রথম আলেকজান্ডারকে পরাভব মানতে বাধ্য করেন । অত:পর আলেকজান্ডার বেশ দীর্ঘ কিছু সময় ভারতবর্ষে অবস্থান করে । পরবর্তীতে পরাজিত , বিধ্বস্ত এবং রণক্লান্ত সেনাবাহিনী দেশে প্রত্যাবর্তনে উণ্মুখ হয়ে পড়লে আলেকজাণ্ডার ভারত অভিযান বন্ধ করে গ্রিসে প্রত্যাবর্তন শুরু করেন। প্রত্যার্তনের পথে তিনি বেলুচিস্তান ও পাঞ্জাব অধিগত করেন; ঝিলাম নদী ও সিন্ধু নদের অন্তবর্তী সকল রাজ্য তার অধিগত হয়। ভারত ভূখণ্ডে আরেকজাণ্ডার প্রায় ১৯ মাস অবস্থান করেছিলেন। তিনি ভারত ত্যাগের পর প্রায় দুই বৎসরকাল তার বিজিত অঞ্চলসমূহে গ্রিক শাসন বজায় ছিল। ভারত থেকে প্রত্যাবর্তনের কিছুদিন পর খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ অব্দে ব্যবিলনে তার অকাল মৃত্যু হয়। অন্যদিকেচন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের নেতৃত্বে মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা পাঞ্জাবে গ্রিক শাসনের অবসান ত্বরান্বিত করে। তবে আলেকজান্ডার ভারতের মূল ভূখণ্ড দখল করতে পারেননি বলে তাকে ভারতবর্ষ বিজয়ের কৃতিত্ব দেয়া হয় না। [৪]