উত্তর আমেরিকার উত্তর-পূর্বাংশে যে প্রাচীন শিলা গঠিত ক্ষয়প্রাপ্ত মালভূমি অবস্থান করছে তাকে কানাডীয় শিল্ড অঞ্চল বলা হয়। বিরাট 'V' আকৃতির এই অঞ্চলটি কানাডার উত্তরাংশে হাডসন উপসাগরকে বেষ্টন করে রয়েছে।[১] পৃথিবীর মোট ১১টি শিল্ড অঞ্চলের মধ্যে এটি বৃহত্তম। 'শিল্ড' কথার অর্থ বর্ম বা ঢাল, তবে এক্ষেত্রে এর অর্থ শক্ত পাথুরে তরঙ্গায়িত ভূমিরূপ।[২]
এই অঞ্চলটি পূর্বে ৫৫° পশ্চিম দ্রাঘিমা থেকে পশ্চিমে প্রায় ১২০° পশ্চিম দ্রাঘিমা এবং দক্ষিণে ৪৫° উত্তর অক্ষাংশ থেকে উত্তরে ৮২° উত্তর অক্ষাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত।[৩] এই অঞ্চলের পূর্ব দিকে ল্যাব্রাডার উচ্চভূমি; পশ্চিম দিকে গ্রেট বেয়ার, গ্রেট স্লেভ, আথাবাস্কা ও উইনিপেগ হ্রদ; উত্তর দিকে সুমেরু মহাসাগর, দক্ষিণ দিকে পঞ্চহ্রদ (সুপিরিয়র, মিশিগান, হুরণ, ইরি, অন্টারিও) ও সেন্ট লরেন্স নদী উপত্যকা অবস্থিত।
কানাডীয় শিল্ড অঞ্চলটি পৃথিবীর প্রাচীনতম ভূখণ্ডের অন্তর্গত। এই অঞ্চলটি প্রধানত গ্রানাইট এবং নিস শিলা দিয়ে গঠিত। তাই এই অঞ্চল শক্ত পাথরের মতাে। দীর্ঘদিন ধরে হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে এই অঞ্চলটি বর্তমানে ক্ষয়প্রাপ্ত মালভূমিতে পরিণত হয়েছে। শিল্ড অঞ্চলের কোনাে কোনাে অংশ ক্ষয়কার্যের ফলে অবনমিত হয়ে হ্রদ সৃষ্টি হয়েছে। যেমন - গ্রেট বিয়ার, গ্রেট স্লেভ, আথাবাস্কা ইত্যাদি। সাধারণত এই অঞ্চলটির ভূমির ঢাল দক্ষিণ থেকে উত্তরে। সেইজন্য নদনদীগুলিও দক্ষিণ থেকে উত্তরদিকে প্রবাহিত হয়ে হাডসন উপসাগরে গিয়ে পড়েছে। এখানকার নদনদীগুলাে হলো - ম্যাকেঞ্জি, চার্চিল, নেলসন। নদীগুলি এই অঞ্চলের পাশাপাশি সৃষ্টি হওয়া বহু হ্রদকে একসঙ্গে যুক্ত করেছে।
শিল্ড অঞ্চলের উত্তর অংশটি অতিশীতল তুন্দ্রা জলবায়ুর অন্তর্গত। বছরের প্রায় সাত মাস তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে থাকে। এই সময় অঞ্চলটি বরফাচ্ছন্ন থাকার জন্য কাজকর্ম করা ও যাতায়াত প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। গ্রীষ্মকাল এখানে খুবই ক্ষণস্থায়ী, তাপমাত্রা খুব বেশি বাড়ে না, প্রায় গড়ে 10 °C.। বৃষ্টিপাত এখানে খুব কমই হয়, অধিকাংশই হয় গ্রীষ্মকালে। মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বছরে 40 cm. এর কম। শিল্ড অঞ্চলের উত্তরে এরুপ জলবায়ুর জন্য এখানে শৈবাল, গুল্ম ও ঔষধি গাছ ছাড়া বড় কোনাে গাছ জন্মাতে পারে না।
শিল্ড অঞ্চলের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্বের অংশটির জলবায়ু উষ্ণু প্রকৃতির। এই অঞ্চলের বার্ষিক উষ্ণতার গড় 40 °C.। এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে সরলবর্গীয় বৃক্ষের অরণ্য দেখা যায়। যেমন - পাইন, ফার, বাচ, ম্যাপল ইত্যাদি। এইসব বনভূমির কাঠ শীতকালে কেটে বরফে ঢাকা নদীতে ফেলে রাখা হয়। গ্রীষ্মকালে বরফ গলে গেলে নদীর স্রোতের মাধ্যমে সহজেই কাঠগুলাে কাঠ চেরাই কলে পৌঁছে যায়। এই কাঠের প্রাচুর্যতার কারণে কানাডা কাষ্ঠশিল্পে বেশ উন্নত।
এখানে সরলবর্গীয় বনভূমিতে বলগা হরিণ, বিভার, বনবিড়াল, লোমশ কুকুর দেখতে পাওয়া যায়। প্রচণ্ড ঠান্ডার এদের শরীর বড় বড় লোমযুক্ত হয়।
শিল্ড অঞ্চল কৃষিকাজে উন্নত নয়। কারণ এখানে বছরের বেশিরভাগ সময় মাটি বরফাবৃত থাকে। তবে হাডসন উপসাগর ও সেন্ট লরেন্স নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে স্বল্প পরিমাণ গম, যব, আলু, ওট, বিট চাষ করা হয়।
প্রাচীন আগ্নেয় ও রূপান্তরিত শিলায় গঠিত হওয়ায় শিল্ড অঞ্চল পৃথিবীর অন্যতম খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ এলাকা। এখনকার প্রধান প্রধান খনিজ সম্পদ ও উত্তোলন কেন্দ্র গুলি নিম্নরূপ:
নিকেল - সাডবেরি (পৃথিবীর বৃহত্তম নিকেল খনি), থমসন।
সোনা - টিমিনিস (পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম স্বর্ণ খনি)।
আকরিক লৌহ - নিউফাউন্ডল্যান্ড, ল্যাব্রাডর-কুইবেক সীমান্ত অঞ্চল।
আকরিক তামা - সাডবেরী, টিমিনিস, নোরান্ডা।
ইউরেনিয়াম - অন্টারিও ও সুপিরিয়র হ্রদ এর নিকটবর্তী অঞ্চলসমূহ।
কোবাল্ট, রুপো, প্লাটিনাম - সাডবেরী, থমসন, শেরিডন।
কানাডার শিল্ড অঞ্চল কৃষিকাজে সমৃদ্ধ না হলেও শিল্পে যথেষ্ট উন্নত। দুর্গম অঞ্চল ও প্রতিকুল প্রাকৃতিক পরিবেশ সত্ত্বেও এখানে শিল্পের উন্নতি ঘটেছে। কারণগুলাে নিম্নরূপ -