গৌরব পদযাত্রা বা প্রাইড প্যারেড (ইংরেজি: Pride parades) নারী ও পুরুষ সমকামী, উভকামী ও রূপান্তরকামী (এলজিবিটি) সংস্কৃতির উৎসব। অনেক সময় সমকামী বিবাহ সহ অন্যান্য আইনগত ইস্যুকে তুলে ধরার জন্যও এই জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। অধিকাংশ গৌরব পদযাত্রাই বার্ষিক অনুষ্ঠান। আধুনিক এলজিবিটি অধিকার আন্দোলনের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা স্টোনওয়াল বিদ্রোহের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে অনেক গৌরব পদযাত্রার আয়োজন করা হয় জুন মাসে।
১৯৬৯ সালের ২৮ জুন, শনিবার অতি প্রত্যুষে নারী ও পুরুষ সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামী ও জিজ্ঞাসু ব্যক্তিরা নিউ ইয়র্কের গ্রিনউইচ ভিলেজের স্টোনওয়াল ইনে পুলিশের আকস্মিক হানার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হন।[১] স্টোনওয়াল ইন ছিল একটি গে বার। এখানে বিভিন্ন ধরনের খরিদ্দারের আনাগোনা ছিল। তবে ক্রস-ড্রেসার, রূপান্তরকামী, মেয়েলি যুবক, যৌনকর্মী ও গৃহহীন যুবকদের মতো সমকামী সমাজের প্রান্তিক মানুষদের কাছে এই বার ছিল বিশেষ জনপ্রিয়। মনে করা হয়, স্টোনওয়াল বিদ্রোহের মাধ্যমেই সূচিত হয় আধুনিক সমকামী অধিকার আন্দোলন। কারণ এই বিদ্রোহের মাধ্যমেই আধুনিক ইতিহাসে এলজিবিটি সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ গ্রেফতারি প্রতিরোধ করে।
১৯৭০ সালের ২৮ জুন, বিদ্রোহের প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষে গে লিবারেশন ফ্রন্ট গ্রিনউইচ ভিলেজের কর্নার উয়েইর থেকে নিউ ইয়র্ক সিটির সেন্ট্রাল পার্ক পর্যন্ত একটি মিছিলের আয়োজন করে।[২][৩][৪] সেই সপ্তাহান্তেই যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট কোস্টের সমকামী অধিকার গোষ্ঠী লস এঞ্জেলসে একটি মিছিল ও সান ফ্রান্সিসকোতে একটি মিছিল ও 'গে-ইন'-এর আয়োজন করে।[৫][৬]
বর্ষপূর্তির ঠিক একদিন আগে, ১৯৭০ সালের ২৭ জুন, শনিবার, শিকাগো গে লিবারেশন একটি মিছিলের আয়োজন করেছিল।[৭] এই মিছিলের আয়োজন করা হয় ওয়াশিংটন স্কোয়ার পার্ক ("বাগহাউস স্কোয়ার") থেকে ওয়াটার টাওয়ারের নিকটস্থ মিশিগান অ্যাভেনিউ ও শিকাগো অ্যাভেনিউয়ের সংযোগস্থল পর্যন্ত। তবে অংশগ্রহণকারীরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে যান সিভিক সেন্টার (অধুনা রিচার্ড জে. ড্যালে) প্লাজা পর্যন্ত।[৮] দুটি কারণে এই দিনটিকে নির্বাচন করা হয়েছিল। প্রথমত, পূর্ববর্তী বছরের জুন মাসের শেষ শনিবারে স্টোনওয়ালের ঘটনাটি ঘটেছিল; দ্বিতীয়ত, উদ্যোক্তারা মিশিগান অ্যাভেনিউয়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক কেনাকাটাকারীদের কাছে নিজেদের বক্তব্য পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। শিকাগোতে এরপর থেকে অন্যান্য কয়েকটি অঞ্চলের মিছিলের সঙ্গে সাযুজ্য বজায় রাখতে জুন মাসের শেষ রবিবার মিছিলের আয়োজন করা হতে থাকে।
প্রথম বছরের গৌরব পদযাত্রার আয়োজন হয়েছিল ভাবগম্ভীর ও আমোদপ্রমোদমূলক পরিবেশের মধ্যে দিয়ে। সমকামী অধিকার আন্দোলনকারীদের মনে এই পদযাত্রা বিশেষ রেখাপাত করে। পরবর্তী বছরগুলির বিশ্বের বিভিন্ন শহরে বার্ষিক পদযাত্রার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। নিউ ইয়র্ক ও আটলান্টা অঞ্চলে এই পদযাত্রাকে বলা হয় গে লিবারেশন মার্চ ও অনুষ্ঠানের দিনটি গে লিবারেশন ডে নামে পরিচিত ছিল। সান ফ্রান্সিসকো ও লস এঞ্জেলসের পদযাত্রা গে ফ্রিডম মার্চ ও অনুষ্ঠানের দিনটি গে ফ্রিডম ডে নামে চিহ্নিত হয়। অন্যান্য শহরে পদযাত্রা ও উৎসব শুরু হলে এই নামগুলি ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৮০-এর দশকে সমকামী আন্দোলনে এক সাংস্কৃতিক পরিবর্তন সূচিত হয়। অপেক্ষাকৃত নরমপন্থী মনোভাবাপন্ন অধিকারকর্মীরা বিভিন্ন শহরে পদযাত্রা আয়োজনের উদ্যোগ নিতে থাকেন। তারা "গে লিবারেশন" বা "গে ফ্রিডম" জাতীয় শব্দ বর্জন করে "সমকামী গৌরব" বা "গে প্রাইড" শব্দটি গ্রহণ করেন।
যেসব দেশে সমকামিতা সামাজিক বা আইনগতভাবে গ্রহণীয় নয়, সেই সব দেশে পদযাত্রার একটি রাজনৈতিক ও আন্দোলনকারী মনোভাব এখনও বজায় আছে। তবে যে সব দেশ সেই সব বাধা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে, সেই সব দেশে গৌরব পদযাত্রা এখন একটি উৎসব অথবা অন্তত মাদ্রি গ্রাস জাতীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বড়ো বড়ো প্যারেডের বৈশিষ্ট্য হল ট্যাবলো, নর্তক-নর্তকী ও ড্রাগ কুইনদের অংশগ্রহণ ও উচ্চকিত সঙ্গীতের প্রয়োগ। তবে এই জাতীয় অনুষ্ঠানেও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা বা বিভিন্ন এলজিবিটি প্রতিষ্ঠানের সদস্যদেরও যোগ দিতে দেখা যায়। অন্যান্য অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মেট্রোপলিটান কমিউনিটি চার্চ ও ইউনিটারিয়ান ইউনিভার্সালিস্ট চার্চের মতো এলজিবিটি-সহায়ক চার্চ এবং প্যারেন্টস অ্যান্ড ফ্রেন্ডস অফ লেসবিয়ানস অ্যান্ড গেস ও বড়ো বড়ো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের এলজিবিটি-কর্মচারী সংঘের সদস্যরা।
তবে সর্বাপেক্ষা উৎসবমুখর পদযাত্রাগুলিতেও এইডস ও এলজিবিটি-বিরোধী সহিংসতার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণ করা হয়। কোনো কোনো পদযাত্রা শহরের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণে পরিণত হওয়ায় সরকার ও কর্পোরেট স্পনসররা সেগুলির অর্থের জোগান দিয়ে থাকেন। কোনো কোনো দেশে গৌরব পদযাত্রাকে এখন বলা হয় গৌরব উৎসব। নিকটবর্তী পার্ক বা শহরেরই কোনো পথে আয়োজিত এই সব অনুষ্ঠান হয় কার্নিভালের মতো করে। এই সব উৎসবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য তথ্যকেন্দ্র, সংগীতানুষ্ঠান, বারবিকিউ, বিয়ার স্ট্যান্ড, প্রতিযোগিতা ও খেলাধুলা।
স্টোনওয়াল বিদ্রোহের অংশগ্রহণকারীরা কেবল পুরুষ সমকামী বা গে ছিলেন না। নারী সমকামী, উভকামী ও রূপান্তরকামীরাও এই বিদ্রোহে অংশ নেন। এমনকি বিদ্রোহের পরবর্তী সমাবেশগুলিতেও তারা একইভাবে অংশ নিতে থাকেন। তা সত্ত্বেও ইতিহাসসম্মতভাবে এই অনুষ্ঠানটিকে গে অনুষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এর কারণ ছিল এই যে সেই যুগে গে শব্দটি বর্তমানকালের ক্যুয়ার বা এলজিবিটি সম্প্রদায়ের নাম হিসেবে ব্যবহৃত হত।[৯][১০][১১]
১৯৭০-এর দশকের শেষভাগে এবং ১৯৮০-এর দশকে স্টোনওয়াল ঘটনার পর আয়োজিত প্রথম অনুষ্ঠানগুলির অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই বৃদ্ধ হয়ে পড়েন, ইস্যু পরিবর্তন করেন অথবা মারা যান। এই কারণে এই সব অনুষ্ঠানে কারা অংশগ্রহণ করেছিলেন তা সঠিক বলা যায় না। এমনকি অধিকার আন্দোলন সংস্থা গে লিবারেশন ফ্রন্ট বা গে অ্যাক্টিভিস্ট অ্যালায়েন্সের প্রথম যুগের সদস্য কারা ছিলেন তাও জানা যায় না। এই কারণেই যখন অনুষ্ঠানের নামে যথার্থ পরিবর্তন আনা হয়, তখন উক্ত সম্প্রদায়ের অনেকেই প্রকৃত ইতিহাসটি না জানার কারণে এই পরিবর্তনের বিরোধিতা [১২] প্রথমে নাম পরিবর্তন করে লেসবিয়ান অ্যান্ড গে করা হয়েছিল। পরে তা হয় লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল অ্যান্ড ট্রান্সজেন্ডার (এলজিবিটি) বা সংক্ষেপে প্রাইড (গৌরব)।
নেদারল্যান্ডের আমস্টারডাম শহরে ১৯৯৬ সাল থেকে গৌরব পদযাত্রা আয়োজিত হয়ে আসছে। সামাজিক স্বীকৃতি অর্জনের ক্ষেত্রে এই পদযাত্রা অনেকটাই সাফল্য পেয়েছে। এই সপ্তাহান্তব্যাপী অনুষ্ঠানে আয়োজিত হয় সংগীতানুষ্ঠান, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও স্ট্রিট পার্টি। এই উৎসবের বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য একটি দিক হল ক্যানাল প্রাইড বা আমস্টারডামের খালগুলিতে নৌকায় প্রাইড প্যারেডের আয়োজন। ২০০৮ সালে ক্যাবিনেটের প্রতিনিধি স্বরূপ তিন জন মন্ত্রী তাদের নিজস্ব বোটে এই প্যারেডে অংশ নেন। আমস্টারডামের মেয়র জব কোহেনও যোগ দিয়েছিলেন অনুষ্ঠানে। প্রায় ৫০০,০০০ দর্শনার্থী অংশ নিয়েছিলেন প্যারেডে। এই বছরই উল্লেখযোগ্য ডাচ আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএনজি গোষ্ঠী ও টিএনটি এনভি এই অনুষ্ঠান স্পনসর করেন।
২০০১ সালের ৩০ জুন সার্বিয়ার এলজিবিটি অধিকার গোষ্ঠীগুলি বেলগ্রেড শহরে প্রথম বার প্রাইড মিছিল আয়োজনের চেষ্টা করেন। অংশগ্রহণকারীরা শহরের প্রধান স্কোয়ারগুলিতে জড়ো হতে শুরু করলে বিরোধীদের একটি বিরাট দল তাদের আক্রমণ করে। ফলে বেশ কয়েকজন অংশগ্রহণকারী আহত হন। মিছিল বন্ধ করে দেওয়া হয়। দাঙ্গা প্রতিরোধ বা অংশগ্রহণকারীদের রক্ষা করতে পুলিশ ব্যর্থ হয়। কয়েক জন আক্রান্ত অংশগ্রহণকারী প্রাণ বাঁচাতে স্থানীয় একটি ছাত্র সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে ঢুকে পড়েন। সেখানে গৌরব পদযাত্রার উপর একটি আলোচনাচক্রের আয়োজন করা হয়েছিল। বিরোধীরা এই ভবনটি ঘিরে ফেলে এবং আলোচনা বন্ধ করে দেয়। পদযাত্রার বিরোধীদের সঙ্গে পুলিশেরও সংঘাত বাধে, তাতে কয়েকজন পুলিশ অফিসার আহত হন।
এনজিও ও একাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তি এই আক্রমণ এবং সরকার তথা নিরাপত্তা বিভাগের নিষ্ক্রিয়তার নিন্দা করেন। সরকারি আধিকারিকবর্গ আক্রমণ সম্পর্কে কোনোরূপ মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন। এমনকি দাঙ্গায় গ্রেফতার হওয়া ৩০ জনের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। এলজিবিটি সম্প্রদায়ের কাছে সার্বিয়া প্রতিকূল মনোভাবাপন্নই থেকে যায়। এর পরেও গৌরব পদযাত্রা আয়োজনের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।[১৩]
প্রথম পূর্ব ইউরোপীয় গৌরব পদযাত্রার নাম ছিল দি ইন্টারন্যাশনালে প্রাইড। ক্রোয়েশিয়া বা অন্যান্য পূর্ব ইউরোপীয় দেশে যেখানে এলজিবিটি সম্প্রদায় সামাজিকভাবে গ্রহণীয় হয়ে ওঠেনি সেখানে এই অনুষ্ঠানই ছিল এই জাতীয় প্রথম উদ্যোগ। পূর্বতন যুগোশ্লাভিয়া সকল রাষ্ট্রগুলির মধ্যে কেবল স্লোভেনিয়া ও ক্রোয়েশিয়াতেই সফলভাবে এই অনুষ্ঠান আয়োজন সম্ভব হয়। ২০০৬ সালে ক্রোয়েশিয়ার জাগ্রেব শহরে যে গৌরব পদযাত্রার আয়োজন করা হয় তাতে পোল্যান্ড সহ তেরোটি পূর্ব ইউরোপীয় দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
২০০৮ সালের ২৯ জুন দিল্লি, বেঙ্গালুরু, পুদুচেরি ও কলকাতায় গৌরব পদযাত্রা আয়োজিত হয়। পরদিন চেন্নাই শহরে আয়োজিত হয় একটি রঙধনু পদযাত্রা। সব মিলিয়ে ২,২০০ জন এই পদযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালে কলকাতা শহরে ভারতের প্রথম গৌরব পদযাত্রা আয়োজিত হয়েছিল।[১৪] ডানপন্থী দলগুলি এই পদযাত্রার বিরোধিতা না করলেও বিজেপি এই পদযাত্রার সমালোচনা করে থাকে। ২০০৮ সালের ১৬ অগস্ট একটি বিশেষ মুম্বই শহরের একটি বিশেষ পদযাত্রার আয়োজন করে সমকামীরা দেশের সমকামিতা-বিরোধী আইনগুলি সংশোধনের দাবি জানান।[১৫] ২০০৯ সালের ২ জুলাই, দিল্লি হাইকোর্ট রায় দিয়েছে যে দুজন ইচ্ছুক প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে সমকামী সম্পর্ক অপরাধমূলক আইনের ধারায় পড়বে না।[১৬]
সিডনি গে অ্যান্ড লেসবিয়ান মাদ্রি গ্রাস অস্ট্রেলিয়ার বৃহত্তম ও বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম প্রাইড অনুষ্ঠান।[১৭] ১৯৭৮ সালের সমকামী অধিকারকর্মীদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১৯৮০-এর দশকের প্রথম দিকে এই অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। এই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় রাতে। প্রায় দশ হাজার অংশগ্রহণকারী সুসজ্জিত ট্যাবলো নিয়ে এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ট্যাবলোগুলির বিষয়বস্তু হয় বিভিন্ন প্রকারের, এমনকি তার মধ্যে রাজনৈতিক বার্তাও প্রচ্ছন্ন থাকে।[১৭][১৮]
২০০৫ সালের ৩০ জুন জেরুজালেমের চতুর্থ বার্ষিক গৌরব পদযাত্রা আয়োজিত হয়েছিল। এই পদযাত্রা স্থানীয় পুরসভা কর্তৃক নিষিদ্ধ হলেও, আলাদত সেই নিষেধাজ্ঞা খারিজ করে দেন। মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ধর্মগুরুরা পুর কর্তৃপক্ষের কাছে পদযাত্রার পারমিট বাতিলের অনুরোধ করেছিলেন। পদযাত্রা চলাকালীন এক হারেদি ইহুদি রান্নাঘরের ছুরি নিয়ে তিন জন অংশগ্রহণকারীকে আহত করেন। ২০০৬ সালে অপর একটি প্যারেড নিয়ে স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অংশগ্রহণকারীদের বিবাদ উপস্থিত হওয়ায় শেষ পর্যন্ত প্যারেডের আয়োজন সর্বসমক্ষে না করে হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয় স্টেডিয়ামের অভ্যন্তরে আয়োজিত হয়। ২০০৭ সালে অবশ্য ব্যাপক পুলিশি নিরাপত্তার মধ্যে কেন্দ্রীয় জেরুজালেমে একটি প্যারেড সফলভাবে আয়োজন করা গিয়েছিল। পরে অবশ্য প্যারেডের সঙ্গে সম্পর্কহীন একটি প্রতিবন্ধকতার কারণে আর প্যারেড আয়োজন করা যায়নি।
২০০৫ সালের ২২ জুলাই বিরোধী জনতা পরিবেষ্টিত অবস্থায় রিগার প্রথম প্রাইড মার্চ অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে পুর কর্তৃপক্ষ এই অনুষ্ঠানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। লাটভিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এই অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করেন। শেষ পর্যন্ত আদালতের রায়ে মিছিলের আয়োজন সম্ভব হয়।[১৯] ২০০৬ সালেই "নো প্রাইড" প্রতিবাদকারীরা মিছিলে হামলা চালায়। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট সহ আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে এই ঘটনা সমালোচিত হয়। ২০০৭ সালে পুলিশি নিরাপত্তার ঘেরাটোপে মিছিল আয়োজিত হলেও "নো প্রাইড" সমর্থকরা সামান্য উত্তেজনা ছড়াতে সমর্থ হয়েছিল। ২০০৮ সালের রিগা প্রাইডও একই রকম ভাবে উদযাপিত হয়।
সাম্প্রতিক দশকগুলিতে উত্তর আমেরিকার প্রগতিশীল সমকামিতা নীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে টরন্টো। অন্টারিও আপিল আদালতে এই শহরের অধিকার কর্মীরা সমকামী-বিবাহ আইনসিদ্ধ করার ব্যাপারে বড়ো সাফল্য পেয়েছেন; যা উত্তর আমেরিকায় প্রথম।[২০] অন্টারিও প্রাইড উইক ফেস্টিভ্যাল তেইশ বছরের পুরনো এবং বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ উৎসব। ২০০৯ সালে এই উৎসবে প্রায় ১,৯০০,০০০ মানুষ যোগ দেন।[২১] ২০১৪ সালে টরন্টোতে ওয়ার্ল্ডপ্রাইডও অনুষ্ঠিত হবে।
১৯৯৪ সালের ২৬ জুন, স্টোনওয়াল বিদ্রোহের রজত জয়ন্তী উপলক্ষে ফিলিপিনসের প্রগ্রেসিভ অর্গানাইজেশন অফ গেজ ও মেট্রোপলিটান কমিউনিটি চার্চের উদ্যোগে ম্যানিলায় প্রথম প্রাইড প্যারেড আয়োজিত হয়। এটি ছিল এশিয়ার প্রথম গৌরব পদযাত্রা। এর পর থেকে ফিলিপিনসে নিয়মিত এই ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়ে আসছে।
২০০৫ সালে ওয়ারশ শহরে একটি পদযাত্রা আয়োজিত হয়। পদযাত্রার আয়োজনে পুর কর্তৃপক্ষ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও তা মানা হয়নি। এই নিষেধাজ্ঞা পরে ইউরোপিয়ান কনভেনশন অফ হিউম্যান রাইটসের পরিপন্থী বলে পরিগণিত হয়। ২০০৮ সালে প্রায় ১,৮০০ লোক এই পদযাত্রায় অংশ নেন।
রাজনীতিবিদ, ধর্মীয় নেতা ও ডানপন্থী সংগঠনগুলির বিরোধের ফলে সেন্ট পিটারসবার্গ ও মস্কোর পুর কর্তৃপক্ষ রাশিয়ায় গৌরব পদযাত্রার আয়োজনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে। মস্কোর মেয়য় ইউরি লুজকোভ প্রস্তাবিত মস্কো প্রাইড অনুষ্ঠানকে "শয়তানের কাজ" বলে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানের আয়োজনকে ঘিরে ইতোমধ্যেই বিরোধী ও প্রতিবিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়ে গেছে। ২০০৭ সালে একটি অপ্রীতিকর ঘটনায় ব্রিটিশ অধিকার আন্দোলনকর্মী পিটার ট্যাটসেল আহত হন।[২২] ২০০৯ সালের মে মাসে একটি ইউরোভিশন সংগীতানুষ্ঠান উপলক্ষে প্যারেডের আয়োজন করা হলে পুলিশ অংশগ্রহণকারীদের গ্রেফতার করে। ২০০৬, ২০০৭ ও ২০০৮ সালের প্যারেডে নিষেধাজ্ঞা জারির জন্য ইউরোপিয়ান কোর্ট অফ হিউম্যান রাইটস-এ রাশিয়াকে ২০১০ সালের ২০ জানুয়ারির মধ্যে জবাবদিহি করতে হবে।[২৩]
"ওরগুলো গে" নামে মাদ্রিদ প্রাইড প্যারেড প্রথম অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৯ সালের ২৮ জুন। বর্তমানে এই উৎসব ইউরোপের বৃহত্তম প্রাইড প্যারেড। একাধিক বহুজাতিক সংস্থা, রাজনৈতিক দল ও ট্রেড ইউনিয়ন এই প্যারেডে অর্থসাহায্য করে থাকে। ২০০৭ সালে ইউরোটাইড নামে ইউরোপিয়ান প্রাইড প্যারেড অনুষ্ঠিত হয় মাদ্রিদেই। ২,৫০০,০০০ মানুষ এই উৎসবে অংশ নেন। এক সপ্তাহের মধ্যে ৩০০টির বেশি অনুষ্ঠানসূচি রাখা হয়। মাদ্রিদের গে ডিস্ট্রিক্ট চুয়েকা ইউরোপের বৃহত্তম গে ডিস্ট্রিক্ট। এই অঞ্চলটিই ছিল তাই উৎসবের কেন্দ্রভূমি। সেদেশের শহর, আঞ্চলিক ও জাতীয় সরকার এই উৎসবে সহায়তা করেন। এছাড়াও বার্সিলোনা, ভ্যালেনসিয়া ও সেভিল শহরেও স্থানীয় গৌরব পদযাত্রা আয়োজিত হয়।
২০০৩ সালে তাইওয়ানের তাইপেইতে প্রথম গৌরব পদযাত্রা আয়োজিত হয়। তাইওয়ানের সমাজে সমকামিতা গ্রহণযোগ্য না হলেও এই পদযাত্রায় প্রচুর মানুষ যোগ দেন। ২০০৮ সালের তাইওয়ান প্যারেডে ১৮,০০০ মানুষ যোগ দিয়েছিলেন। তেল আভিভ শহরের গৌরব পদযাত্রার পরে[২৪] এটিই ছিল এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম গৌরব পদযাত্রা।[২৫]
২০০৩ সাল থেকে ইস্তাম্বুল ও ২০০৮ সাল থেকে আঙ্কারায় তুরস্ক গৌরব পদযাত্রা আয়োজিত হচ্ছে। এই পদযাত্রা প্রথমে ছোটো আকারে অনুষ্ঠিত হলেও পরে অধিক সংখ্যক মানুষ এতে যোগ দিতে শুরু করেন।
গৌরব পদযাত্রার বিরোধিতা যেমন এলজিবিটি-বিরোধী গোষ্ঠীরা করে থাকে, তেমনই উক্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকেও এই অনুষ্ঠানের বিরোধিতার কথা জানা যায়। অনেকে এই ধরনের অনুষ্ঠানকে খোলামেলা যৌন বিষয়বস্তুর প্রদর্শনী বলে এর সমালোচনা করেছেন। কারো কারো মতে, এই ধরনের অনুষ্ঠান "সমকামী সম্প্রদায়"কে হাস্যস্পদ করে তুলছে।[২৬]