নাইট টেম্পলার খ্রিস্ট ও সলোমনের মন্দিরের দরিদ্র সহ-সৈনিকবৃন্দ Pauperes commilitones Christi Templique Solomonici | |
---|---|
সক্রিয় | ১১১৯ - ১৩১২ খ্রিস্টাব্দ |
আনুগত্য | পোপতন্ত্র |
ধরন | খ্রিস্টান সামরিক আইন |
আকার | চরম উৎকর্ষের সময় সদস্য সংখ্যা ১৫,০০০-২০,০০০ জন যাদের মধ্যে ১০% ছিল নাইট।[১][২] |
সদর দফতর | টেম্প্ল মাউন্ট, জেরুসালেম |
ডাকনাম | অর্ডার অফ দ্য টেম্প্ল |
পৃষ্ঠপোষক | ক্লেয়ারভক্সের সেন্ট বার্নার্ড |
Attire | লাল ক্রসসহ একটি সাদা ম্যান্ট্ল |
যুদ্ধসমূহ | ক্রুসেড, যার মধ্যে রয়েছে: মন্টগিসার্ডের যুদ্ধ (১১৭৭), হাটিনের যুদ্ধ (১১৮৭), আরসুফের যুদ্ধ (১১৯১), একর দখল (১১৯০-১১৯১), একর দখল (১২৯১) রিকনকুইস্টা |
কমান্ডার | |
ফার্স্ট গ্র্যান্ড মাস্টার | Hugues de Payens |
লাস্ট গ্রান্ড মাস্টার | জ্যাক দ্য মোলেই |
খ্রিস্ট ও সলোমনের মন্দিরের দরিদ্র সহ-সৈনিকবৃন্দ (লাতিন: Pauperes commilitones Christi Templique Salomonici) সাধারণ মানুষের কাছে নাইট টেম্পলার নামে পরিচিত। এছাড়া একে অর্ডার অফ দ্য টেম্প্ল-ও বলা হয়ে থাকে। খ্রিষ্টান সামরিক যাজক সম্প্রদায়গুলোর (অর্ডার) মধ্যে এটিই সবচেয়ে বিখ্যাত এবং পরিচিত।[৩] মধ্য যুগে প্রায় দুই শতক ব্যাপী এই সংগঠনের অস্তিত্ব বিরাজমান ছিল। ১০৯৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ক্রুসেডের পরই এর সৃষ্টি হয় যার উদ্দেশ্যে ছিল জেরুসালেমে আগত বিপুল সংখ্যক ইউরোপীয় তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। জেরুসালেম মুসলিমদের দখলে চলে যাওয়ার পরই এই নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
১১২৯ খ্রিস্টাব্দে চার্চ এই সংগঠনকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন দান করে। এর পর থেকে যাজক সম্প্রদায়টি গোটা ইউরোপের সবচেয়ে জনপ্রিয় দাতব্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এর সদস্য সংখ্যা এবং একই সাথে ক্ষমতা বিপুল হারে বাড়তে থাকে। স্বতন্ত্র ধরনের লাল ক্রস সংবলিত আলখাল্লা পরিধান করার কারণে যে কোন টেম্পলার নাইটকে সহজেই চিহ্নিত করা যায়। তারা ছিল ক্রুসেডের সময়কার সর্বোৎকৃষ্ট অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত, সর্বোচ্চ মানের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এবং সর্বোচ্চ শৃঙ্খলাবিশিষ্ট যোদ্ধা দল।[৪] এই যাজক সম্প্রদায়ের সদস্যদের মধ্যে যারা যোদ্ধা ছিল না তারা সমগ্র খ্রিষ্টান রাজত্ব জুড়ে এক সুবৃহৎ অর্থনৈতিক অবকাঠামো নির্মাণ করেছিল। অর্থ উপার্জনের নব্য নতুন সব উপায় উদ্ভাবনের জন্য তারা বিখ্যাত। তাদের এই সব কাজকর্ম ছিল প্রাচীনতম ব্যাংকি ব্যবসার নমুনা।[৫][৬] তারা ইউরোপ এবং পবিত্র ভূমি জুড়ে প্রচুর দুর্গ তৈরি করেছিল।
টেম্পলারদের সাফল্য ক্রুসেডের সময় অনেকাংশেই সাধারণ ক্রুসেডারদের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। খ্রিষ্টানরা যখন পবিত্র ভূমির কর্তৃত্ব হারায় এবং ক্রুসেডাররা নির্মমভাবে পরাজিত হয় তখনই এই যোদ্ধা যাজক সম্প্রদায়ের প্রতি সমর্থন অনেকাংশে কমে আসে। টেম্পলারদের গোপন সূচনা অনুষ্ঠান অনেকের মনে সন্দেহের উদ্রেক করে যাদের মধ্যে ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ ৪-ও ছিলেন। ফিলিপ ৪ তদানীন্তন পোপ ক্লিমেন্ট ৫-কে টেম্পলারদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। ১৩০৭ খ্রিস্টাব্দের ১৩ অক্টোবর রাজা ফিলিপ ৪ ফ্রান্সের বিপুল সংখ্যক টেম্পলারদের আটক করে তাদের উপর নির্যাতন চালান। অনেককে পুড়িয়ে মারা হয়।[৭] ১৩১২ খ্রিস্টাব্দে পোপ ক্লিমেন্ট রাজা ফিলিপের অব্যাহত চাপে পড়ে অবশেষে নাইট টেম্পলার সংগঠনটিকে চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এর অব্যবহিত পরেই ইউরোপের বিপুল সংখ্যক অবকাঠামো নিরুদ্দেশ হয়ে যায় যা অনেক কিংবদন্তি এবং গল্পের জন্ম দেয়। এ কারণে আধুনিক কল্পকাহিনীতেও টেম্পলারদের সরব উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
প্রথম ক্রুসেডের শেষে ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে জেরুসালেম মুসলিম শাসকদের হাত থেকে ফ্র্যাঙ্কদের অধিকারে আসে। এরপর প্রচুর খ্রিষ্টান তীর্থযাত্রী নিয়মিত এই পবিত্র ভূমিতে গিয়ে উপাসনা করত। শহরটিতে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকলেও অবশিষ্ট বহিঃস্থ অংশে তা ছিল না। উপকূল রেখা থেকে পবিত্র ভূমির উদ্দেশ্যে জাফা যাবার পথে প্রচুর তীর্থযাত্রী ডাকাত দলের আক্রমণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করত। মাঝে মাঝে এই সংখ্যা একবারে একশ ছাড়িয়ে যেত।[৮]
১১১৯ খ্রিস্টাব্দের দিকে দুজন যুদ্ধপ্রবীণ, ফ্রান্সের রাজা নাইট হুগুয়েস ডি পায়েন্স এবং তার আত্মীয় গডফ্রি ডি সেইন্ট-ওমার, এই তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য একটি যোদ্ধা যাজকসম্প্রদায় গড়ে তোলার প্রস্তাব পেশ করে।[৯] জেরুসালেমের তৎকালীন রাজা বাল্ডউইন ২ তাদের এই প্রস্তাব অনুমোদন করে এবং জেরুসালেমের খ্রিষ্টানদের অধিকৃত আল আকসা মসজিদের অভ্যন্তরে অবস্থিত টেম্পল মাউন্টে তাদের জন্য একটি সদর দফতরের ব্যবস্থা করে দেয়। টেম্পল মাউন্ট তথা মন্দির পর্বতটির এক অতীন্দ্রিয় বিশেষত্ব ছিল, কারণ বিশ্বাসমতে এটি সোলমনের মন্দিরের ধ্বংসস্তূপের উপর অবস্থিত ছিল।[৪][১০] ক্রুসেডাররা তাই আল আকসা মসজিদকে সোলমনের মন্দির বলে ডাকতো এবং এই স্থানের নাম হতেই নাইট টেম্পলাররা তাদের নামের সোলমনের মন্দির এবং খ্রিস্টের দরিদ্র সহযোগী-সৈনিকবৃন্দ (টেম্পলার নাইট) অংশটি নিয়েছিল। মাত্র নয়জন নাইটের মাধ্যমে গঠিত এই যাজকসম্প্রদায়কে প্রথমত শুধুমাত্র দানের অর্থের উপর নির্ভর করতে হত। তাদের আর্থিক অবস্থা ছিল খুব খারাপ। তাদের প্রতীকে একই ঘোড়ার উপর দুজন নাইটকে বসে থাকতে দেখা যায় যা তাদের এই দারিদ্র্যের পরিচয় বহন করে।[১১]
খুব বেশিদিন নাইট টেম্পলারদেরকে এই হতদরিদ্র অবস্থায় থাকতে হয়নি। অচিরেই তারা একজন প্রভাবশালী ধনী পৃষ্ঠপোষক লাভ করে। তিনি হলেন ক্লেইভক্সের বার্নার্ড যিনি চার্চ গোষ্ঠীতে বিশেষ প্রভাবের অধিকারী ছিলেন এবং নাইট টেম্পলারের প্রতিষ্ঠাতা একজন নাইটের ভাতিজা ছিলেন। তিনি নাইট টেম্পলারদের পক্ষে শক্তিশালী লেখা লিখতে থাকেন এবং বিভিন্ন মহলে তাদের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বক্তৃতা করতে থাকেন। তার এসব কার্যক্রমের ফলশ্রুতিতেই ১১২৯ সালে কাউন্সিল অফ ট্রয়েসে খ্রিষ্টান চার্চ নাইট টেম্পলারদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। চার্চের এই স্বীকৃতি লাভের কারণে টেম্পলাররা সমগ্র ইউরোপ জুড়ে খ্রিষ্টান দাতব্য কার্যক্রমের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়। যেসব ব্যক্তি ও ধনী পরিবার পবিত্র ভূমি রক্ষার যুদ্ধে শরীক হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করত তারা অর্থ, জমি, ব্যবসা এবং মহান রক্ত বহনকারী ছেলেদের সরবরাহ করার মাধ্যমে এই যুদ্ধে অংশ নেয়। টেম্পলারদের পক্ষে আরেকটি প্রধান আনুকুল্য প্রদর্শিত হয় ১১৩৯ খ্রিস্টাব্দে। এই বছর পোপ ইনোসেন্ট ২ Omne Datum Optimum নামক আজ্ঞাপত্রের মাধ্যমে এই যাজকসম্প্রদায়কে স্থানীয় আইন ও নিয়মনীতি থেকে অব্যাহতি দেয়। এর অর্থ ছিল, নাইট টেম্পলাররা সীমানা নির্বিশেষে যেকোন স্থানে বা দেশে ভ্রমণ করতে পারবে, তাদের কোন কর প্রদান করতে হবেনা এবং একমাত্র পোপের আইন ব্যতীত অন্য কারো আইন বা শাসনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে তারা বাধ্য থাকবে না।[১২]
"একজন টেম্পলার নাইট সত্যিকার অর্ধেই ভয়হীন, এবং সকল দিকই নিরাপদ, কারণ তার আত্মা বিশ্বাসের ঢালের মাধ্যমে রক্ষিত, ঠিক যেমন তার দেহ রক্ষিত ইস্পাতের ঢালের মাধ্যমে। এভাবে সে দুই ঢালের মাধ্যমে রক্ষিত হয়, এবং এ কারণে মানুষ বা শয়তান কাওকে ভয় করার কারণ আর অবশিষ্ট থাকেনা।" |
বার্নার্ড দ্য ক্লেইভক্স, ১১৩৫ খ্রিস্টাব্দ, De Laude Novae Militae - নতুন নাইটহুডের প্রশংসায়[১৩] |
পরিষ্কার অভিযান এবং বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পত্তি কারণে এই যাজকসম্প্রদায় খুব দ্রুত বিকশিত হয়। ক্রুসেডের অধিকাংশ যুদ্ধেই তখন টেম্পলার নাইটদেরকে অগ্রসর বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়। কারণ যুদ্ধবাজ উঁচুমানের ঘোড়ায় চড়ে তারা সহজেই প্রতিপক্ষ শক্তির সামনের সারির ব্যুহ ভেদ করতে পারতো এবং প্রথম সারির পতন ঘটাতে তারা ছিল পটু। তাদের অন্যতম প্রধান বিজয় ছিল ১১৭৭ খ্রিস্টাব্দের মন্টগিসার্ডের যুদ্ধে। এই যুদ্ধে মাত্র ৫০০ জন টেম্পলার নাইটের সহযোগিতায় খ্রিষ্টান বাহিনী মুসলিম সেনানায়ক সালাদিনের ২৬,০০০ সৈন্যের বাহিনীকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছিল।[১৪]
এই যাজকসম্প্রদায়ের মূল উদ্দেশ্যে সামরিক হলেও খুব কম সংখ্যক নাইটই সামনের কাতারে থেকে যুদ্ধে অংশ নিতো। অবশিষ্ট নাইটরা সমর্থক এবং সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করত। তাদের কাজ ছিল যোদ্ধা টেম্পলারদেরকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সহায়তা করা এবং আর্থিক অবকাঠামো নির্মাণ করে বাহিনীকে সচল রাখা। ব্যক্তিগতভাবে সব নাইট দরিদ্র হলেও দানের বাইরে তাদেরকে প্রভূত অর্থ-সম্পদের নিয়ন্ত্রণের অধিকার দেয়া হয়েছিল। যেকোন মহৎ ব্যক্তি, যে ক্রুসেডে অংশ নিতে ইচ্ছুক ছিল কিন্তু কোন কারণে সরাসরি যুদ্ধে পারঙ্গম ছিলনা, সে তার সকল সম্পত্তি টেম্পলারদের হাতে তুলে দিয়ে এই যাজকসম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হতে পারতো। ইউরোপ এবং আশেপাশের এলাকা জুড়ে এভাবে বিপুল সম্পত্তি জড়ো করার পর টেম্পলাররা পবিত্র ভূমির তীর্থযাত্রীদেরকে ঋণপত্র প্রদান শুরু করে। তীর্থযাত্রীরা পবিত্র ভূমির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করার আগে তাদের যাবতীয় অর্থ-সম্পদ স্থানীয় টেম্পলারদের কাছে জমা করতো। স্থানীয় টেম্পলাররা তাকে গুপ্তভাবে সংকেতায়িত একটি দলিল হস্তান্তর করতো যাতে তার জমা করা সম্পদের পরিমাণ লেখা আছে। পবিত্র ভূমিতে পৌঁছে এই দলিল দেখালেই সেখানকার টেম্পলারদের কাছ থেকে সে তার অর্থ ফেরত পেয়ে যেতো। এই নতুন উদ্ভাবনটিই প্রথম চেক তথা হুণ্ডির ব্যবহার হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। এই পদ্ধতি তীর্থযাত্রীদেরকে অনেক স্বচ্ছন্দ এবং নিরাপদ করেছিল। কারণ ডাকাতদের হাতে কাগজটি পড়লেও তারা তার মর্ম উদ্ধার করতে না পারায় কোন সম্পত্তি হস্তগত করতে পারতো না। এছাড়া এই কাজ করে টেম্পলারদের আর্থিক অবস্থাও বিশেষ উন্নত হয়েছিল।[৪][১৫]
এরকম মিশ্র দান এবং ব্যবসায়িক চুক্তির মাধ্যমে টেম্পলাররা সমগ্র খ্রিষ্টান রাজত্বে একটি দৃঢ় আর্থিক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করেছিল। ইউরোপ এবং মধ্য প্রাচ্যে তারা প্রচুর অর্থ ও জমি লাভ করেছিল। এছাড়া তারা খামার ও আঙুরের ক্ষেত ক্রয় ও চাষাবাদ, চার্চ এবং দুর্গ নির্মাণ, বাণিজ্যিক পণ্য উৎপাদন, আমদানি ও রপ্তানী ইত্যাদি নানা ধরনের কাজ করত। তাদের নিজস্ব নৌ বাহিনী ছিল। এমনকি একসময় তারা সমগ্র সাইপ্রাস দ্বীপের মালিকানা অর্জন করেছিল। বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও টেম্পলারদেরকেই পৃথিবীর প্রথম বহুজাতিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।[১৪]
দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ক্রুসেডের ফলাফল পরিবর্তিত হতে শুরু করে। সালাদিনের মত যোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতার নেতৃত্বে মুসলিম বিশ্ব আরও ঐক্যবদ্ধ হয় এবং খ্রিষ্টান অঞ্চলের মধ্যে অন্তর্কোন্দল দেখা দেয়। নাইট টেম্পলাররা মাঝেমধ্যেই অন্য দুটি প্রধান খ্রিষ্টান যাজকসম্প্রদায়ের সাথে বিবাদে লিপ্ত হত। অন্য দুটি অর্ডার হল নাইট হসপিটালার এবং টিউটোনীয় নাইট। দশকব্যাপী বিবাদের কারণে খ্রিষ্টানরা অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। বেশ কয়েকটি যুদ্ধে টেম্পলাররা হেরে যায়। অবশেষে হাটিনের যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে জেরুসালেম পুনরায় সালাদিনের মুসলিম বাহিনীর দখলে আসে। টেম্পলারদের কোন সাহায্য ছাড়া কুসেডাররা ১২২৯ খ্রিস্টাব্দে স্বল্প সময়ের জেরুসালেম পুনরুদ্ধার করে। ১২৪৪ খ্রিস্টাব্দে খোয়ারিজমীয় তুর্কীরা আবার জেরুসালেম দখল করে নেয় এবং এর পর ১৯১৭ সাল পর্যন্ত অঞ্চলটি মুসলিমদের দখলে থাকে। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশরা অটোমান তুর্কীদের কাছ থেকে জেরুসালেম দখল করে।[১৬]
টেম্পলাররা তাদের সদর দফতর উত্তরের শহরগুলোতে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। প্রথমে ইসরাইলের Acre শহরে সদর দফতর স্থাপন করে। প্রায় এক শতাব্দীকাল এখানে থাকার পর ১২৯১ সালে এই শহরও মুসলিমদের অধিকারে আসে। অগত্যা টেম্পলাররা তাদের শেষ আশ্রয়স্থলে এসে ঠেকে। তাদের শেষ আশ্রয়স্থল ছিল টারটোসা (বর্তমান সিরিয়া) এবং আটলিট। তখন তাদের উপকূলবর্তী সদর দফতর ছিল কেবল একটি, সাইপ্রাসের লিমলে।[১৭] এছাড়া টারটোসা সমুদ্রোপকূল থেকে খানিক দূরের আরওয়াদ দ্বীপে তাদের একটি ক্ষুদেকায় সেনানিবাস ছিল। ১৩০০ সালের দিকে তারা মোঙ্গলদের সাথে মিলে কিছু যুদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল যা ছিল ফ্রাঙ্কো-মোঙ্গল মৈত্রীর একটি অংশ।[১৮] এর মধ্যে আরওয়াদ দ্বীপে আগ্রাসী বাহিনী প্রেরণ। ১৩০২ বা ১৩০৩ সালে টেম্পলাররা তাদের এই শেষ আশ্রয়স্থলটিও হারায়। পবিত্র ভূমিতে এটিই ছিল তাদের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল।[১৪][১৯]
এত ঘটনার পর অবশেষে এই যাজকসম্প্রদায়ের আর্থিক সাহায্য ও পৃষ্ঠোপোষকতা কমে যেতে থাকে। ইউরোপে তারা তাদের জনপ্রিয়তা হারায়। দুই শতাব্দীর কার্যক্রমের মাধ্যমে এক সময় টেম্পলাররা ইউরোপীয়দের প্রাত্যহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাড়ালেও সে সময়কার পরিস্থিতি চিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ও জটিল।[২০] পুরো খ্রিষ্টান রাজত্ব জুড়ে স্থাপনা এবং ভবন নির্মাণের কারণে তারা স্থানীয় পর্যায়েও সর্বত্র উপস্থিত ছিল। সামরিক পতনের পরও তাই তারা অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করত। তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল কিছু ব্যবসা এবং ব্যাংক ব্যবস্থা যা তারাই প্রতিষ্ঠা করেছিল। অনেকেই তখনও তাদের খামারে কাজ করে জীবিকা অর্জন করত। তখনও তারা কোন স্থানীয় সরকারের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য ছিলনা, তাদের ছিল একটি সংগঠিত সেনাবাহিনী যা যেকোন সীমান্ত নির্বঘ্নে অতিক্রম করতে পারত যদিও এই সেনাবাহিনীর ছিলনা কোন নির্দিষ্ট যুদ্ধক্ষেত্র। এভাবে অনেক ক্ষেত্রে তারা হয়ে দাড়িয়েছিল এক রাষ্ট্রের ভিতরে আরেক রাষ্ট্র। এভাবে নিজেদের একটি যাজককেন্দ্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থও হয়তো পরিলক্ষিত হচ্ছিল ঠিক যেমনটি টিউটোনীয় নাইটরা প্রুশিয়ার ক্ষেত্রে করেছিল।[১৫]
১৩০৫ খ্রিস্টাব্দে নতুন পোপ ক্লিমেন্ট ৫ টেম্পলারদের গ্র্যান্ড মাস্টার জ্যাক ডি মোলে এবং হসপিটালারদের গ্র্যান্ড মাস্টার ফাল্ক ডি ভিলারেট উভয়ের কাছেই পত্র পাঠান আর বিষয় ছিল এই দুই যোদ্ধা যাজকসম্প্রদায়ের একীকরণ। কেউই বিষয়টি মেনে নেয়নি। কিন্তু পোপ বারবার তাদের বিশেষ অনুরোধ করতে থাকেন এবং এক পর্যায়ে উভয়কে ফ্রান্সে এসে এ ব্যাপারে আলচনায় অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানান। ডি মোলে ১৩০৭ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে উপস্থিত হলেও ডি ভিলারেট প্রান্সে পৌঁছাতে কয়েক মাস বিলম্ব করেন। এই সময়ে ক্লিমেন্ট এবং ডি মোলে এক বহিষ্কৃত টেম্পলার নাইট কর্তৃক উপস্থাপিত একটি মামলা বিষয়ে আলোচনা করেন। সবাই মোটামুটি একমত হয়েছিলেন যে তার উত্থাপিত তথ্যগুলো মিথ্যা, তথাপি ক্লিমেন্ট ফ্রান্সের তৎকালীন রাজা ফিলিপ ৪-এর কাছে মামলার তদন্তের ব্যাপারে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে একটি পত্র লিখেন। কিন্তু নিজস্ব আর্থিক সুবিধার স্বার্থে ফিলিপ টেম্পলারদের এসকল গুজব বিষয়ে তদন্তের কোন চেষ্টা করেননি। টেম্পলারদের কাচে তার অনেক ঋণ ছিল। মূলত ইংরেজদের সাথে তার যুদ্ধের কারণেই তাকে ঋণ নিতে হয়েছিল। তিনি বিভিন্ন সময় টেম্পলারদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার জন্য চার্চকে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন, যাতে তার ঋণের বোঝা নেমে যায়।[২১]
অক্টোবর ১৩, ১৩০৭ রোজ শুক্রবার (যে দিনটি অনেকেই ভুল করে বিখ্যাত ফ্রাইডে দ্য থারটিন্থ কুসংস্কারের সাথে মিলিয়ে ফেলেন)[২২] রাজা ফিলিপ জ্যাক ডি মোলে এবং অন্যান্য ফরাসি টেম্পলারদের আটক করার নির্দেশ দেন। তাদেরে বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহীতা এবং উৎপথে চলার অভিযোগ আনা হয়। আটকের পর তাদেরকে বিশ্বাসঘাতকতার মিথ্যা স্বীকৃতি দেয়ার আগ পর্যন্ত নির্যাতন করা হয়। যদিও তাদের স্বীকৃতিগুলো জোরপূর্বক আদায় করা হয়েছিল, তথাপি তা প্যারিসে প্রভূত গুজবের সৃষ্টি করে। রাজা ফিলিপের আরও জোর জবরদস্তির প্রতি সাড়া দিয়ে পোপ ক্লিমেন্ট একটি আজ্ঞাপত্র ইস্যু করেন যার নাম Pastoralis Praeeminentiae। এই আজ্ঞাপত্রে সকল খ্রিষ্টান রাজাকে স্থানীয় টেম্পলারদের আটক করা এবং তাদের সম্পত্তি ক্রোক করার আদেশ দেয়া হয়।[২৩]
টেম্পলারদেরকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য পোপের কাছে সভা আহ্বানের অনুরোধ জানানো হয়। পোপের ছাড় দেয়ার প্রেক্ষিতে এক সময় অনেক টেম্পলার ইনকুইজিশনের নির্যাতন থেকে রেহাই পায়। ইনকুইজিশন থেকে বেরিয়ে অনেক টেম্পলারই তাদের পূর্বতন স্বীকৃতি অমূলক বলে প্রত্যাহার করে। অনেকেরই নিজের স্বপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ ছিল যা তাদেরকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারে। কিন্তু ১৩১০ ক্রিস্টাব্দে রাজা ফিলিপ আদালতে পুনরায় আপিল করার এই সুযোগ বন্ধ করে দেন। এরপর তার নির্দেশে আগের স্বীকৃতির জের ধরেই কয়েক ডজন টেম্পলার নাইটকে প্যারিসের অগ্নিখুটিতে বেঁধে পুড়িয়ে মারা হয়।[২৪][২৫]
তার ইচ্ছা বাস্তবায়িত না হলে টেম্পলারদের বিপক্ষে সামরিক পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে ফিলিপ পোপকে ভয় দেখান। অগত্যা পোপ ক্লিমেন্ট এই যাজকসম্প্রদায়কে চার্চের আওতা বহির্ভুক্ত তথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। টেম্পলারদের যে মিথ্যা স্বীকারোক্তিগুলো ফ্রান্সের জনমনে গুজবের সৃষ্টি করেছিল সেগুলোকেই এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ১৩১২ সালে কাউন্সিল অফ ভিয়েনে পোপ বেশ কয়েকটি আজ্ঞাপত্র ইস্যু করেন যার মধ্যে ছিল, Vox in excelso যা যাজকসম্প্রদায়টিকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করে এবং Ad providam যা টেম্পলারদের অধিকাংশ সম্পত্তি হসপিটালারদের কাছে হস্তান্তরিত করে।[২৬]
টেম্পলার যাজকসম্প্রদায়ের নেতাদের সম্মান রক্ষার্থে তাদের বয়জ্যেষ্ঠ্য গ্র্যান্ড মাস্টার জ্যাক ডি মোলে, যিনি স্বীকারোক্তির কারণে নির্যাতিত হচ্ছিলেন, তার প্রতি যে বিচার করা হয়েছে তাকে অমূলক বলে প্রত্যাখ্যান করেন। তার সহযোগী নরমান্ডির প্রিসেপটর জেফ্রি ডি চার্নি-এ একই পথ অনুসরণ করেন এবং নিজেকে নির্দোষ বলে দাবী করতে থাকেন। এই দুজনকেই ধর্মদ্রোহীতা এবং উৎপথে চরার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় এবং নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকার অপরাধে ১৩১৪ সালের মার্চ ১৮ তারিখে প্যারিসে পুড়িয়ে মারা হয়। ডি মোলে মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনমনীয় ছিলেন বলে প্রচলিত মত থেকে জানা যায়। তিনি তাকে খুটির সাথে এমনভাবে বাঁধতে বলেছিলেন যাতে নটর ডেম ক্যাথেড্রাল দেখতে পারেন। এছাড়া মৃত্যুর কলে ঢলে পড়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি হাত জোড় করে প্রার্থনা করছিলেন।[২৭] লোকমুথে প্রচলিত আছে, অগ্নিশিখা জ্বলতে থাকা অবস্থায় তিনি বলেছিলেন যে, শীঘ্রই ঈশ্বরের সামনে তার সাথে পোপ ক্লিমেন্ট এবং রাজা ফিলিপের দেখা হবে। এর কয়েক মাস পরেই পোপ ক্লিমেন্ট মারা যান এবং রাজা ফিলিপ সেই বছরের শেষ দিকে এক শিকার অভিযানে বেরিয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন।[২৮]
টেম্পলারদের শেষ কয়েকজন নেতা চলে যাওয়ার পর অধিকাংশ সদস্যদেরই তিনটি পরিণতি হতে দেখা গিয়েছিল। হয় তাদেরকে আটক করে পোপতান্ত্রিক বিচারের মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হয়েছে যদিও কারও বিরুদ্ধেই তেমন কোন অপরাধ প্রমাণিত হয়নি, নয়তো অন্যান্য সামরিক যাজকসম্প্রদায় যেমন নাইট হসপিটালারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, অথবা পেনশন এবং ভাতা প্রদানের মাধ্যমে শান্তিতে বসবাসের সুযোগ দেয়া হয়েছে। অনেক টেম্পলারই পোপের শাসন বহির্ভুত অঞ্চল যেমন যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন স্কটল্যান্ডে চলে গিয়েছিল। পর্তুগালের টেম্পলাররা কেবল তাদের নাম পরিবর্তন করার মাধ্যমে নতুনভাবে কাজ শুরু করে। তাদের নতুন নাম হয় অর্ডার অফ ক্রাআস্ট।[২৯]
২০০১ সালে ভ্যাটিকান গোপন সংগ্রহশালায় একটি অভিনব দলিল পাওয়া গেছে যা চিনন পার্চমেন্ট নামে পরিচিত। এই দলিলটি সম্ভবত ১৬২৮ সালে ভুল করে অন্য একটি ফাইলের মধ্যে রাখা হয়েছিল। যাহোক, এই দরিল থেকে জানা গেছে, ১৩১২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে টেম্পলার সম্পদ্রায়কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার আগে ১৩০৮ খ্রিস্টাব্দে পোপ ক্লিমেন্ট তাদের বিরুদ্ধে আনীত সকল ধর্মদ্রোহীতার অভিযোগ থেকে তাদেরকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন। অর্থাৎ প্রথমে নিজ বিচার বুদ্ধি দিয়ে তিনি টেম্পলারদেরকে নির্দোষ বললেও পরে স্বার্থের খাতিরে বা অন্য কোন কারণে তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন।[৩০][৩১] এই দলিলটি মূলত টেমস্পলারদের মামলার তথ্যাদিতে পরিপূর্ণ। ২০০৭ সালের অক্টোবর মাসে স্ক্রিনিয়াম পাবলিশিং হাউজ, যারা ভ্যাটিকানের হয়ে দলিলপত্র প্রকাশ করে থাকে, টেম্পলারদের মামলা সংশ্লিষ্ট দলিলপত্র প্রকাশ করে যার মধ্যে চিনন পার্চমেন্টও অন্তর্ভুক্ত ছিল।[৩১]
বর্তমানে রোমান ক্যাথলিক চার্চ স্বীকার করেছে যে, মধ্যযুগে নাইট টেম্পলারদের অবস্থান সম্পূর্ণ সঠিক ছিল। তারা অন্যায় কিছু করেনি এবং তাদের যাজকসম্প্রদায় সম্পূর্ণ খ্রিষ্টান ধর্মীয় আইন মোতাবেকই কাজ করেছিল। পোপ ক্লিমেন্ট তখন সে ধরনের আজ্ঞাপত্র ইস্যু করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বাধ্য হওয়ার কারণ ছিল জনসাধারণের মধ্যে স্ফুলিঙ্গের মত ছড়িয়ে পড়া গুজবের চাপ এবং প্রভাবশালী রাজা ফিলিপ ৪-এর অসাধারণ প্রভাব।[৩২]
নাইট টেম্পলাররা একটি যাজক সম্প্রদায় হিসেবে সংগঠিত হয়েছিল, যা অনেকটা আর্নার্ডের সিস্টারসিয়ান সম্প্রদায়ের মত। সিস্টারসিয়ান ছিল ইউরোপের প্রথম কার্যকর আন্তর্জাতিক সংগঠন।[৩৩] টেম্পলারদের সাংগঠনিক গঠনে নেতৃত্বের বিশাল ধারাক্রমিক বিন্যাস ছিল। যে সকল দেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক টেম্পলার ছিল সেখানে বা সে অঞ্চলে তাদের একজন প্রধান নেতা ছিল যার পদবি ছিল মাস্টার অফ দ্য অর্ডার অফ দ্য টেম্পলার্স। এ রকম অঞ্চলগুলি ছিল ইংল্যান্ড, আরাগন, পর্তুগাল, পৈতু, আপুলিয়া, জেরুসালেম, ত্রিপোলি, এন্টিয়ক, আনজৌ এবং হাঙ্গেরি।[৩৪] সকল মাস্টার অফ দ্য অর্ডার অফ দ্য নাইট্স আবার সরাসরি গ্র্যান্ড মাস্টারের আনুগত্য স্বীকার করত। গ্র্যান্ড মাস্টার সবসময়েই একজন ফরাসি নাইট হত এবং তাকে সারা জীবনের জন্য নির্বাচন করা হত। গ্র্যান্ড মাস্টার পূর্বাঞ্চলে টেম্পলারদের সামরিক অভিযান এবং পশ্চিমাঞ্চলে তাদের আর্থিক কর্মতৎপরতা সবকিছুর সার্বিক দেখভালের দায়িত্বে থাকত। টেম্পলারদের সংখ্যা ঠিক কত ছিল তা বলা যায় না। তবে জানা যায় স্বর্ণযুগে তাদের সংখ্যা ছিল ১৫,০০০ থেকে ২০,০০০ যার মধ্যে শতকরা দশ ভাগ ছিল আসল নাইট।[১][২]
Bernard de Clairvaux এবং টেম্পলারদের প্রতিষ্ঠাতা হুগুয়েস ডি পায়েন্স একসাথে মিলে টেম্পলার যাজকসম্প্রদায়ের জন্য সুনির্দিষ্ট আচরণ বিধিমালা রচনা করেছিলেন যা আধুনিক ইতিহাসবিদদের কাছে "ল্যাটিন আইন" নামে পরিচিত। এই বিধিমালার ৭২টি ধারা একজন নাইটের আচরণের সুস্পষ্ট বিধি নির্দেশ করে দেয়, যেমন তাদের কেমন ধরনের পোশাক পরিধান করতে হবে, কয়টি ঘোড়া থাকতে হবে ইত্যাদি। নাইটদেরকে নিঃশব্দে খাবার গ্রহণ করতে হতে, তারা সপ্তাহে তিনবারের বেশি মাংস খেতে পারত না, কোন নারীর সাথে কোন ধরনের শারীরিক সম্পর্কে জড়াতে পারত না, এমনকি নিজ পরিবারের মধ্যেও নয়। মাস্টার অফদ্য অর্ডারকে দেয়া হত, "৪টি ঘোড়া, একজন নিজস্ব যাজক ভ্রাতা এবং দুটি ঘোড়াসহ একজন কর্মচারী, এবং দুটি ঘোড়াসহ একজন সার্জেন্ট ভ্রাতা, এবং একটি ঘোড়াসহ একন সম্মানিত পরিচারক যে তার বর্শা ও ঢাল বহন করত।"[৩৫] সম্প্রদায়টির পরিসর এবং সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের বিধিমালাতে আরও ধারা সংযুক্ত হয়। শেষের দিকে এই সংখ্যা কয়েকশো ছাড়িয়ে গিয়েছিল।[৩৬][৩৭]
টেম্পলারদের মধ্যে মূলত তিনটি পদমর্যাদা ছিল: অভিজাত নাইট, নিচুস্থানীয় সার্জেন্ট এবং যাজক। নাইটদেরকে অবশ্যই মধ্যযুগীয় অভিজাত নাইট বংশধারার অন্তর্ভুক্ত হতে হত এবং তাদেরকে সাদা আলখাল্লা পরিধান করতে হত। তাদের প্রত্যেকে অশ্বারোহী সেনাদলের মত সজ্জিত করে দেয়া হত। প্রত্যেকের সাথে থাকতো তিন বা চারটি করে ঘোড়া এবং এক বা দুজন করে অনুচর। অনুচরের সাধারণত যাজকসম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হতনা। তাদরকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আশপাশের এলাকা থেকে ভাড়া করে নিয়ে আসা হত। নিচু মর্যাদার সামাজিক শ্রেণী থেকে আসা লোকদের বলা হত সার্জেন্ট। তারা নাইট ছিল না।[৩৮] তাদেরকে হালকা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করা হত। তাদের সাথে থাকতো একটি ঘোড়া। এছাড়া সার্জেন্টদের মধ্যেই কেউ কেউ অন্যভাবে সম্প্রদায়ের কাজে লাগত। যেমন, সম্পত্তির দেখভাল করা এবং বাণিজ্য ও মুদ্রা বিষয়ক কাজকর্ম পরিচালনা করা। এই সম্প্রদায়ের আরেকটি শ্রেণী ছিল পরিচারক এবং যাজক। এরা সাধারণত চিরস্থায়ি যাজক হিসেবে কাজ করত। তাদের দায়িত্ব ছিল টেম্পলারদের আধ্যাত্মিক দাবী মেটানো।[৩৯]
নাইটরা লাল ক্রস সংযুক্ত একটি সাদা পোশাক এবং তার উপর একটি সাদা আলখাল্লা পরিধান করত। সার্জেন্টরা পরিধান করত সামনে বা পিছনে লাল ক্রস সংযুক্ত কালো রঙের টিউনিক এবং কালো বা বাদামী রঙের আলখাল্লা।[৪০][৪১] ১১২৯ খ্রিস্টাব্দে কাউন্সিল অফ ট্রয়েসে নাইটদের জন্যে এ ধরনের সাদা আলখাল্লাকে মনোনীত করা হয়েছিল, পোশাকের সাথে লাল ক্রসটি সম্ভবত পরবর্তিতে তথা ১১৪৭ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ক্রুসেড শুরু হওয়ার সময় সংযোজন করা হয়। সে বছর ফ্রান্সের প্যারিসের নিকটে টেম্পলারদের সদর দফতরে পোপ ইউজিন ৩ এবং ফ্রান্সের রাজা লুই ৭ এবং অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ নাইট ফরাসি টেম্পলারদের এক সভায় অংশ নেন। এই সভাতেই লাল ক্রস সংযোজনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।[৪২][৪৩][৪৪] তাদের নিয়ম অনুযায়ী টেম্পলার নাইটদেরকে সর্বদা এই আলখাল্লা পরে থাকতে হত। এমনকি এই আলখাল্লা না পরে খাওয়া বা পানাহারও নিষিদ্ধ ছিল।[৪৫] টেম্পলাররা তাদের পোশাকে যে লাল ক্রস পরিধান করত তা ছিল শাহাদাতের প্রতীক।
টেম্পরার নাইটদের অভিষেকটি ছিল বিশেষ গুরুত্ববহ যা অভ্যর্থনা (ল্যাটিন: receptio) নামে পরিচিত ছিল। যাজক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হতে হলে একজন সাধারণ নাইটকে বিশেষ অঙ্গীকারে আবদ্ধ হতে হত। এ কারণে অভিষেকের সময়কার অনুষ্ঠানটিও ছিল বিশেষ ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ। সাধারণ মানুষ তথা সম্প্রদায় বহির্ভুতদেরকে এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নিরুৎসাহিত করা হত। এই নিরুৎসাহিতকরার ব্যাপারটিই শেষ সময়ে টেম্পলারদের বিরুদ্ধে পরিচালিত মামলাগুলোতে মধ্যযুগীয় ইনকুইজিশনকারীদের পক্ষে সাক্ষ্য সরবরাহ করেছিল।
নতুন সদস্যদের তাদের সমুদয় সম্পত্তি এবং অর্থ যাজক সম্প্রদায়ের কাছে সমর্পণ করতে হত এবং তাদেরকে বেছে নিতে হত দারিদ্র্য, কৌমার্য, ধর্মানুরাগ এবং আনুগত্যের জীবন।[৪৬] অধিকাংশ ভ্রাতাই সারা জীবনের জন্য সম্প্রদায়ভুক্ত হত, যদিও অনেককে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য যোগ দেয়ার অনুমতি দেয়া হত। কখনও কখনও বিবাহিত ব্যক্তিদেরও যোগ দিতে দেয়া হত যদি তাদের স্ত্রীর অনুমতি থাকত,[৪১] তবে তাদের সাদা আচ্ছাদন পরার অনুমতি থাকত না[৪৭]।
যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করাটাকে বিরাট সম্মান ও সৌভাগ্যের বিষয় বলে জ্ঞান করা হত এবং তাদের স্থান স্বর্গে বলে প্রচার করা হত।[৪৮] একটি বিশেষ কার্ডিনাল আইন ছিল, যুদ্ধক্ষেত্রে টেম্পলারদের পতাকার পতন হওয়ার আগ পর্যন্ত কেউ আত্মসমর্পণ করতে পারবে না, এবং পতাকা পড়ে যাওয়ার পরও তাদের চেষ্টা করতে হবে অন্য যাজকসম্প্রদায় যেমন হসপিটালারদের সাথে যোগ দিয়ে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। সবগুলো পতাকার পতন হলেই কেবল তারা যুদ্ধক্ষেত্রে ত্যাগ করতে পারত।[৪৯] তাদের এই অনমনীয় নীতি, তাদের কিংবদন্তিসম সাহসিকতা, অসাধারণ প্রশিক্ষণ এবং ভারী অস্ত্রশস্ত্রের কারণে টেম্পলার নাইটরা মধ্য যুগের অন্যতম বিধ্বংসী সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল।[৫০]
প্রতিষ্ঠাতা হুগুয়েস ডি পায়েন্স (১১১৮-১৯) থেকে শুরু করে গ্র্যান্ড মাস্টারের দপ্তরই ছিল টেম্পলারদের সর্বোচ্চ দপ্তর। গ্র্যান্ড মাস্টারের পদটি একজন সারা জীবনের জন্য লাভ করত। অবশ্য জীবনের শেষ দিকে এসেই কেউ এ ধরনের পদলাভ করতে পারত। দুইজন বাদে সব গ্র্যান্ড মাস্টারই যার যার দফতরে মৃত্যুবরণে করেছেন। কয়েকজন অবশ্য যুদ্ধক্ষেত্রেও মৃত্যুবরণ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, আসকালন দখলের সময় তথা ১১৫৩ খ্রিস্টাব্দে গ্র্যান্ড মাস্টার Bernard de Tremelay চল্লিশ জন টেম্পলারের একটি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। দলটি নিয়ে তিনি নগর প্রতিরক্ষা প্রাচীরের ফাঁকা স্থান অতিক্রম করছিলেন। টেম্পলার নাইটদের অবশিষ্ট অংশ যখন আর তাদের অনুসরণ করতে পারেনি তখন বাধ্য হয়ে গ্র্যান্ড মাস্টারসহ টেম্পলারদের এই দলটি আত্মসমর্পণ করে এবং তাদের শিরশ্ছেদ করা হয়।[৫১] গ্র্যান্ড মাস্টার Gérard de Ridefort-ও হেরে গিয়েছিলেন একর দখলের সময়। যুদ্ধের পর ১১৮৯ খ্রিস্টাব্দে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন সালাদিন।
পূর্ব ইউরোপে টেম্পলারদের সামরিক অভিযান এবং পশ্চিম ইউরোপে তাদের আর্থিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমের পুরোটা দেখভালের শীর্ষ দায়িত্বে থাকতেন গ্র্যান্ড মাস্টার। পবিত্র ভূমিকে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে মুক্ত রাখার মূল দায়িত্ব ছিল তারই। কয়েকজন গ্র্যান্ড মাস্টার নিজেই যুদ্ধক্ষেত্রে সেনানায়ক হিসেবে যুদ্ধকরেছেন যদিও তা খুব একটা বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত ছিল না। যেমন গ্র্যান্ড মাস্টার Gerard de Ridefort-এর নেতৃত্বের কারণেই হাটিনের যুদ্ধে টেম্পলারদের কয়েকটি পরাজয় এসেছিল। শেষ গ্র্যান্ড মাস্টার ছিলেন জ্যাক ডি মোলে যাকে ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ ৪-এর নির্দেশে প্যারিসে পুড়িয়ে মারা হয়।[২৫]
সামরিক অভিযান এবং উন্নত মানের আর্থিক অবকাঠামোর সুবাদে টেম্পলাররা বিপুল সামর্থ অর্জন করেছিল। এই সামর্থের কারণেই তারা পবিত্র ভূমি এবং ইউরোপ জুড়ে প্রচুর ভবন এবং কাঠামো নির্মাণ করতে পেরেছিল। এর মধ্যে অনেকগুলো কাঠামো এখনও বিদ্যমান রয়েছে। অনেকগুলো স্থানই এখনও টেম্পল শব্দটি বহন করে চলেছে যা তাদের টেম্পলার নামের উৎস হিসেবে চিহ্নিত।[৫২] উদাহরণস্বরূপ, লন্ডনে অবস্থিত টেম্পলারদের কিছু ভূমি পরবর্তিতে আইনজ্ঞদের কাছে ভাড়া দেয়া হয়েছিল। আইন এবং টেম্পলারদের স্মৃতি মিলে তাই লন্ডনের এই স্থানগুরোর নাম হয়েছে টেম্পল বার, এবং টেম্পল টিউব স্টেশন।
টেম্পলারদের দ্বারা নির্মিত গঠন এবং কাঠামোসমূহের অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন এগুলোতে অনেক সময়ই টেম্পলারদের বৈশেষ্ট্যসূচক প্রতীক এবং চিহ্ন খোদিত দেখা যায়, যেমন একই ঘোড়ায় বসে থাকা দুজন নাইটের ছবি, যা তাদের আদি দারিদ্র্যকে চিত্রায়িত করে। এছাড়া তারা গোলাকার ভবন নির্মাণ করত যা জেরুসালেমের পবিত্র চার্চের আদলকে উপস্থাপন করত।
গোপনীয় অথচ শক্তিশালী মধ্যযুগীয় টেম্পলারদের গল্প, বিশেষত তাদের যন্ত্রণাভোগ ও তাৎক্ষণিক অবলুপ্তি বেশ কিছু আধুনিক সংগঠনকে উৎসাহিত করেছে। তারা নিজেদের সম্মান, ইতিহাস এবং রহস্যকে বিধৃত করার জন্যই মূলত টেম্পলারদের ঐতিহ্যকে অধিগ্রহণ করেছে। অনেকগুলো সম্প্রদায়ই নিজেদেরকে আদি টেম্পলারদের সাথে সরাসরি সংশ্লিষ্ট বলে দাবী করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই ফ্রিম্যাসনরা ও ইলুমিনাতি টেম্পলারদের প্রতীক ও আচার-অনুষ্ঠানগুলো অনসরণ শুরু করে।[৪] এমনকি তারা একটি নতুন নাম নেয় যাতে সদস্যরা উদ্বুদ্ধ হয়, নামটি ছিল "অর্ডার অফ দ্য নাইট টেম্পলার"। ১৮০৪ সালে সোভারেন মিলিটারি অর্ডার অফ দ্য টেম্পল অফ জেরুসালেম নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয় যা অধুনা জাতিসংঘ কর্তৃক দাতব্য সংগঠন হিসেবে এনজিও মর্যাদা লাভ করেছে।[৫৩]
টেম্পলাররা চতুর্দশ শতাব্দীতেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তাদের সাথে আধুনিক এসব সংগঠন, যাদের প্রবীণতমটিরই জন্ম অষ্টাদশ শতাব্দীতে, তাদের কোন সংযোগ আছে বলে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি। তথাপি জনমনে এ নিয়ে রয়েছে অনেক সংশয় এবং গুজব। অনেকেই তাই দুই যুগের মধ্যে ৪০০ বছরের এই ব্যবধানকে উপেক্ষা করতে পছন্দ করেন।
গুপ্ত তথ্য এবং রহস্যের কারণে নাইট টেম্পলাররা অনেক কিংবদন্তির উপদান হয়ে আছে। টেম্পলারদের জীবদ্দশাতেই এ ধরনের কিংবদন্তির কথা প্রচলিত ছিল যা গুজব বলে আখ্যায়িত হতেও পারে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফ্রিম্যাসন লেখকরা বিভিন্ন নিবন্ধ-প্রবন্ধ এবং কল্পকাহিনীতে এ সম্বন্ধে তাদের নিজস্ব চিন্তা ব্যক্ত করেছেন। আধুনিক গল্প, উপন্যাস এবং চলচ্চিত্রেও টেম্পলারদের সরব উপস্থিতি রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সর্বাধিক বিক্রিত উপন্যাসসমূহ। যেমন: ইন্ডিয়ানা জোন্স অ্যান্ড দ্য লাস্ট ক্রুসেড, আইভানহো, ন্যাশনাল ট্রেজার, ফুকো'স পেন্ডুলাম, দ্য লাস্ট টেম্পলার এবং দ্য দা ভিঞ্চি কোড।[৪]
টেম্পলারদের সম্বন্ধে সর্বাধিক জনপ্রিয় ও পরিচিত কিংবদন্তি হচ্ছে প্রথম দিকে পবিত্র ভূমিতে তাদের কাজ নিয়ে। সে সময় জেরুসালেমের পবিত্র ভূমি রক্ষার্থে তারা কাজ করতেন। কাজকরতে গিয়ে তারা সেখানে পবিত্র কি কি স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পেয়েছিলেন এবং সেগুলোর কি করেছিলেন তা নিয়েই সংশয় প্রকাশ করেছেন সবাই। অনেকে হলি গ্রেইল এবং আর্ক অফ দ্য কনভেনেন্ট-এর কথা বলেছেন।[৪][১৫][৫০] তারা সেখানকার কিছু পবিত্রতম স্মৃতিচিহ্নের রক্ষাকর্তা হিসেবে কাজ করছিলেন এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। অনেক চার্চ এখনও প্রচুর স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ করে এবং সেগুলো প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে, যেমন: এক সাধুর হাড়, একজন পবিত্র মানুষ কর্তৃক পরিধেয় বস্ত্রের একটি খণ্ড বা এক শহীদের মাথার খুলি। টেম্পলাররাও পবিত্র ভূমিতে এই কাজটি করেছিলেন। কিন্তু তারা কি সংরক্ষণ করেছিলেন? দলিল প্রমাণাদির ভিত্তিতেই বলা হয়েছে, তারা সেখানে একটি প্রকৃত ক্রস খুঁজে পেয়েছিলেন। একরের বিশপ সেই ক্রসটি নিয়ে হাটিনের যুদ্ধে যান।[৫৪] যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর সালাদিন ঐ স্মৃতিচিহ্ন অধিকার করে নেয়। অবশ্য ১১৯১ খ্রিস্টাব্দে মুসলিমরা যখন একর শহরে আত্মসমর্পণ করে তখন এগুলো আবার ক্রুসেডারদের হাতে ফিরে এসেছিল।[৫৫] এছাড়াও বলা হয় টেম্পলাররা চালসেডনের সাধু ইউফেমিয়ার মাথা সংরক্ষণ করতেন। টেম্পলারদের ইনকুইজিশনের সময়েও এই পবিত্র স্মৃতিচিহ্নের কথাগুলো এসেছিল যা তারা গোপনে সংরক্ষণ করত। কয়েকটি মামলার দলিল দস্তাবেজে ঘেটে দেখা গেছে সেখানে এক মাথা ন্যাড়া বিড়ালের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, টেম্পলাররা এই বিড়ালের উপাসনা করে, আবার স্থানে স্থানে বাফোমেঁ (Baphomet) নামক একজনের কথা বলা হয়েছে যার অনুসরণ করার জন্য টেম্পলারদের শাস্তি হয়। বাফোমেঁ ইংরেজি মুহাম্মদ শব্দের বিকৃত ফরাসি উচ্চারণ।[৪][৫৬]
ক্রুসেডারদের যুগে টেম্পলারদের সাথে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি জড়িয়ে পড়েছে তা হল হলি গ্রেইল। এমনকি দ্বাদশ শতকেও এ ধরনের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়। গ্রেইল রোমান্টিকতা নিয়ে প্রথম গল্প লেখা হয়েছিল ১১৮০ সালে। ক্রেতিয়েন ডি ত্রয়েস কর্তৃক লিখিত এই গল্পের নাম ছিল লে কন্তে দু গ্রাল। ডি ত্রয়েস সেই এলাকারই লোক ছিলেন যেখানে কাউন্সিল অফ ট্রয়েস আনুষ্ঠানিকভাবে টেম্পলার যাজকসম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। আর্থারীয় কিংবদন্তিতে গ্রেইল অনুসন্ধানের নায়ক স্যার গালাহাডকে এমন একটি ঢাল বহন করতে দেখা যায় যাতে সেন্ট জর্জের ক্রস খোদিত। এই প্রতীকটি টেম্পলারদেরই অনুরূপ। সে যুগের শিভালরীয় মহাকাব্য Parzival-এ রচয়িতা উলফ্রাম ভন এসচেনবাখ লিখেছেন, হলি গ্রেইল সম্রাজ্যকে পাহাড়া দিচ্ছে টেম্পলাররা।.[৫৭] এ ধরনের কিংবদন্তির কারণ হিসেবে বলা যায়, যেহেতু টেম্পলারদের সদর দফতর ছিল জেরুসালেমের টেম্পল মাউন্টে, সেহেতু তারা অবশ্যই সেখানে খননকার্য চালিয়ে হলি গ্রেইল উদ্ধার করেছে। উদ্ধার করার পর তারা তা গোপন করেছে এবং নিজেদের জীবনের বিনিময়ে হলেও তাকে রক্ষা করেছে। অবশ্য টেম্পলাররা কখনও হরি গ্রেইল উদ্ধার করেছেন বলে কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। তাদের ইনকুইজিশনের সময়কার দলিল দস্তাবেজে গ্রেইল সংশ্লিষ্ট কোন কথাই নেই।[১৪] অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী মনে করেন হলি গ্রেইলের বিষয়টি একটি কল্পকাহিনী বৈ অন্য কিছু নয়। মধ্য যুগে এটি বিস্তৃতি লাভ করেছে বলে তারা মনে করেন।[৪][১৫]
টেম্পলারদের সাথে সংশ্লিষ্ট আরেকটি বিখ্যাত কিংবদন্তি হচ্ছে তুরিনের অবগুণ্ঠন নিয়ে। ১৩৫৭ খ্রিস্টাব্দেজেফ্রি ডি চার্নির নাতির পরিবার প্রথম বারের মত এই অবগুণ্ঠন প্রদর্শন করেছিল। তার এই নাতি ছিলেন টেম্পলারদের শেষ গ্র্যান্ড মাস্টার জ্যাক ডি মোলে যাকে ১৩১৪ সালে প্যারিসে পুড়িয়ে মারা হয়। এই কৃত্রিমবস্ত্রের কিংবদন্তিটি এখনও প্রভূত বিতর্কের সৃষ্টি করে। কার্বন ডেটিং দ্বারা জানা গেছে এই বস্ত্রটি আনুমানিক ১২৬০ থেকে ১৩৯০ সালের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। এই সময়টি হল টেম্পলারদের রাজত্বের শেষ অর্ধ শতাব্দী।[৫৮]
|তারিখ=
(সাহায্য)