বংশাণুবিজ্ঞান |
---|
ধারাবাহিকের একটি অংশ |
বংশাণুবিজ্ঞান হল বংশাণু, বংশগতিক বৈশিষ্ট্য এবং এক জীব থেকে আরেক জীবের জন্মগত চারিত্রিক সাযুজ্য ও পার্থক্য সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান। বংশাণুবিজ্ঞানের ইংরেজি পরিভাষা হল "জেনেটিকস", যা বিজ্ঞানী উইলিয়াম বেটসন ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রবর্তন করেন।
জীবমাত্রই যে তার পিতা-মাতার বৈশিষ্ট্য আহরণ করে তা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মানুষের জানা এবং নির্বাচিত প্রজননের মাধ্যমে তারা শস্য ও গৃহপালিত পশুর মধ্যে কাঙ্ক্ষিত গুণাবলীর সমাবেশ ঘটিয়েছেন। তবে বংশগতির মূলসূত্র অনুসন্ধানে অভীষ্ট আধুনিক বংশাণুবিজ্ঞানের বয়স খুব বেশি নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে অস্ট্রিয়ান ধর্মযাজক গ্রেগর মেন্ডেলের গবেষণার মধ্য দিয়ে এই বিজ্ঞানের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। [১] তখনো মানুষ বংশগতির গাঠনিক ভিত্তি সম্বন্ধে খুব বেশি অবহিত ছিল না। তদসত্ত্বেও মেন্ডেল তার পর্যবেক্ষণ থেকে ধারণা করেছিলেন পিতা-মাতা থেকে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হয় বংশগতির কিছু বিচ্ছিন্ন একক দ্বারা, যাদের পরবর্তীতে বংশাণু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বংশাণু ডিএনএ'র নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে। ডিএনএ হল এমন একটি অণু যা কিনা চারটি ভিন্ন প্রকৃতির নিউক্লিওটাইডে তৈরি, যাদের বিন্যাসই কোনো অর্গানিজমের বংশাণুগত বৈশিষ্ট্যাদি নির্ধারণ করে দেয়। ডিএনএ সাধারণতঃ দ্বি-সর্পিল তন্তুর ন্যায় বিন্যাসিত থাকে ; যেখানে কোন একটি নিউক্লিওটাইড অপর তন্তুতে অবস্থিত নিউক্লিওটাইডের পরিপূরক। প্রতিটি তন্তুই ডিএনএ প্রতিলিপিকরণের সময় তার পরিপূরক তন্তুর জন্যে ছাঁচ হিসাবে কাজ করে, যা কি-না উত্তরাধিকার সূত্রে বংশাণু প্রতিলিপিকরণের ভৌত পদ্ধতি।
বংশাণুর নিউক্লিওটাইডের পরম্পরা অনুযায়ী জীবকোষ অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরি করে। অ্যামিনো অ্যাসিড থেকে দেহসার বা প্রোটিন উৎপন্ন হয় - প্রোটিনে অ্যামিনো অ্যাসিডের ক্রম আর বংশাণুতে নিউক্লিওটাইডের ক্রম অভিন্ন রকম হয়ে থাকে। নিউক্লিওটাইডের ক্রম আর অ্যামিনো অ্যাসিডের ক্রমের এই সম্পর্ককে বংশগতীয় সঙ্কেত (জেনেটিক কোড) বলে। প্রোটিনে অবস্থিত অ্যামিনো অ্যাসিড নির্ধারণ করে প্রোটিনের ত্রি-মাত্রিক গঠন কী-রূপ হবে; আর এর গঠন প্রোটিনের কাজ কী হবে তা নির্ধারণ করে। বংশাণুতে অবস্থিত ডিএনএ'র একটি ছোট্ট পরিবর্তন প্রোটিন গঠনকারী অ্যামিনো অ্যাসিডের আকার ও কাজে বড় ধরনের পরিবর্তন সৃষ্টি করতে পারে, যা কিনা ঐ কোষ ও সম্পূর্ণ জীবদেহে নাটকীয় পরিবর্তন আনতে পারে।
যদিও বংশাণুবিজ্ঞান কোন জীবের বাহ্যিক গঠন ও আচরণ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বংশাণুবিজ্ঞান আর জীবসত্ত্বার অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে তার বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয়। যেমন, যদিও বংশাণু কোন ব্যক্তির উচ্চতা নির্ধারণ করে, তবু তার বাল্যকালের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ব্যাপারটিও এতে বড় প্রভাব ফেলে।
১৮শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মেন্ডেলের তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক কাজের মাধ্যমে বংশাণুবিজ্ঞানের সূচনা হলেও তার আগেও বংশবৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে কিছু ধারণা প্রচলিত ছিলো। মিশ্র উত্তরাধিকার নামক একটি তত্ত্ব মেন্ডেলের আমলে খুব জনপ্রিয় ছিল। এ সরল তত্ত্ব অনুযায়ী কোন জীব তার বাবা-মার বৈশিষ্ট্য সমূহের যথাযথ মিশ্রণের অধিকারী হয়। মেন্ডেলের কাজ এই তত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করে এবং দেখায় যে চরিত্র বৈশিষ্ট্য বংশাণু মিশ্রণ নয়, বরং ভিন্ন ভিন্ন বংশাণুর সমন্বয়। সে সময় আরেকটি মতবাদ প্রচলিত ছিল: পিতা-মাতার শক্তিশালী বংশাণুগুলোই তাদের উত্তরপ্রজন্ম পরিগ্রহ করে। এই তত্ত্বটি (যা কিনা জ্যঁ বাপ্তিস্ত লামার্কের সাথে জড়িত)বর্তমানে ভুল প্রমাণিত হয়েছে: কোন একক সত্ত্বার বৈশিষ্ট্য ও অভিজ্ঞতার ওপর তার ভবিষ্যত প্রজন্মে বংশাণুর অতিক্রমণ নির্ভর করে না। [২] অন্যান্য তত্ত্বের মধ্যে রয়েছে চার্লস ডারউইনের প্যানজেনেসিস (যার মধ্যে উত্তরাধিকার ও আহরণ দুটো প্রক্রিয়াই ছিল) এবং ফ্রান্সিস গ্যালটনের ব্যক্তিগত ও উত্তরাধিকারে প্যানজেনেসিসের পুনর্বিন্যাস।[৩]
আধুনিক বংশাণুবিজ্ঞানের সূচনাপর্ব অনুসন্ধান করলে দেখা যায় গ্রেগর ইয়োহান মেন্ডেল নামক এক জার্মান-চেক অগাস্টিনিয়ান সন্ন্যাসী ও বিজ্ঞানী প্রথম উদ্ভিদে বংশবৈশিষ্ট্য প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করেন। তার নিবন্ধ "Versuche über Pflanzenhybriden" (উদ্ভিদ সঙ্করায়নের পরীক্ষা), যা তিনি ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রুনোর Naturforschender Verein (প্রকৃতি গবেষণা সমাজ)-এ উপস্থাপন করেন, তাতে তিনি নির্দিষ্ট কিছু মটরশুঁটি গাছের বৈশিষ্ট্যসমূহের বংশগতিগত উদ্ভব অনুসন্ধান করেন এবং তাদের গাণিতিকভাবে সূত্রাবদ্ধ করেন।[৪] যদিও বংশগতির এই বিন্যাস কেবল অল্প কিছু আচরণের ব্যাখ্যা দিতে পারত, এই তত্ত্বটির সাফল্য ছিল তা দেখায় বংশগতি কণাসদৃশ পদার্থে তৈরি এবং তা আহরণযোগ্য নয়।
মেন্ডেলের কাজ ১৮৯০'র দশকের পূর্ব পর্যন্ত লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে গিয়েছিল, তার মৃত্যুর পর একই সমস্যা নিয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানীরা তার সূত্রগুলো পুনঃআবিষ্কার করেন। উইলিয়াম বেটসন, মেন্ডেলের কাজের একজন প্রস্তাবক, ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে জেনেটিক্স শব্দটির প্রচলন করেন। [৫][৬](বংশাণুবিজ্ঞান শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ জেনেসিস - γένεσις , "উৎপত্তি" থেকে এবং এই শব্দটির বিশেষ্য জেনো - γεννώ, "জন্ম দেওয়া" আগেই ১৮৬০ সালে জীববিজ্ঞানগত অর্থে ব্যবহার করা হয়।) [৭] বেটসন ১৯০৬ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত তৃতীয় আন্তর্জাতিক উদ্ভিদ সংকরায়ণ আলোচনাসভায় তার উদ্বোধনী বক্তৃতায় বংশগতিবিদ্যার অধ্যয়ন বোঝাতে বংশাণুবিজ্ঞান শব্দটি ব্যবহার করেন। [৮]
মেন্ডেলের কাজের পুনঃআবিষ্কারের পর বিজ্ঞানীরা জীবকোষে বংশগতির বাহক বংশাণুসমূহের শনাক্তকরণের কাজ শুরু করেন। ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে টমাস হান্ট মর্গান ফ্রুট ফ্লাইতে সাদা চোখের সেক্স-লিংকড মিউটেশানের ওপর ভিত্তি করে দাবী করেন বংশাণু জীবকোষের অন্তর্গত ক্রোমোসোমে অবস্থান করে। [৯] ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে তার ছাত্র আলফ্রেড স্টার্টেভান্ট বংশাণুগত লিংকেজ ব্যবহার করে দেখান বংশাণু ক্রোমোসোমে রৈখিকভাবে সাজানো থাকে।[১০]
বংশাণু ক্রোমোসোমে অবস্থিত এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেলেও বিজ্ঞানীরা জানতেন না ক্রোমোসমের দুই উপাদান প্রোটিন ও ডিএনএ-এর মধ্যে কোন উপাদানটি বংশবৈশিষ্ট্যেরে ধারক ও বাহক। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রেডেরিক গ্রিফিথ বংশাণুগত রূপান্তর আবিষ্কার করেন (বিস্তারিত: ): মৃত ব্যকটেরিয়া তার বংশাণুাটিক বস্তু জীবিত ব্যাকটেরিয়াতে পাঠিয়ে তাকে রূপান্তর করতে পারে। ষোল বছর পর ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে অসওয়াল্ড থিয়োডর এভারি, কলিন ম্যাকলিওড এবং ম্যাকলিন ম্যাককার্টি এই রূপান্তরের জন্যে দায়ী কণা হিসেবে ডিএনএকে শনাক্ত করেন। [১১] ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে হার্শলে-চেজের পরীক্ষণও প্রতিপাদন করে যে ডিএনএ-ই (প্রোটিন নয়) হল ভাইরাসের সেই জেনেটিক বস্তু যা কিনা ব্যাকটেরিয়াকে সংক্রমণ করে। এই প্রতিপাদন বংশবৈশিষ্ট্যের ধারক ও বাহক হিসেবে ডিএনএ'র ভূমিকা আরো নিশ্চিত করে।[১২]
জেমস ডি. ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে মরিস উইলকিন্স ও রোসালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনের এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি ব্যবহার করে করা কাজ, যা ডিএনএ সর্পিলাকার (অর্থাৎ কর্ক-স্ক্রূর মত) নির্ধারণ করে তা থেকে ডিএনএ'র গঠন উদ্ঘাটন করেন।[১৩][১৪] তাদের দ্বি-সর্পিল মডেলে দুটো সুতোর মতো অংশ থাকে , যাতে একট সুতোর নিউক্লিওটাইডগুলো ভেতরের দিকে অপর সুতোয় থাকা নিজ-নিজ সম্পূরক নিউক্লিওটাইডের সাথে যুক্ত হয়, যা দেখতে অনেকটা প্যাঁচানো সিঁড়ির ধাপের মতো হয়। [১৫] এই গঠন নির্দেশ করে যে বংশাণুগত তথ্য ডিএনএ'র সুতোয় নিউক্লিওটাইডের ক্রমের ওপর নির্ভর করে। এই মডেল ডিএনএ'র দ্বৈতকরণেরও (duplication) একটি সহজ ব্যাখ্যা দেয়: যদি সুতোগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তবে পূর্বের সুতোর গঠন অনুসরণ করেই নতুন সম্পূরক সুতো তৈরি হয়।
যদিও ডিএনএ'র গঠন থেকে বংশগতির ব্যাখ্যা প্রদান করা সম্ভব হয়, কিন্তু ডিএনএ কেমন করে কোষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে তা জানা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী বছরগুলোতে বিজ্ঞানীরা ডিএনএ কী করে প্রোটিন তৈরির কাজটি নিয়ন্ত্রণ করে তা বুঝতে চেষ্টা করেন। জানা যায় ডিএনএ ছাঁচ হিসেবে ব্যবহার করে কোষ অনুরুপ বার্তাবাহক আরএনএ (messenger RNA) (নিউক্লিওটাইড যুক্ত অণু, অনেকটা ডিএনএ'র মতো) তৈরি করে। বার্তাবাহক আরএনএ'র নিউক্লিওটাইড ক্রম থেকে প্রোটিনে অ্যামিনো অ্যাসিডের]] ক্রম তৈরি হয়; নিউক্লিওটাইড ও অ্যামিনো অ্যাসিডের ক্রমের মধ্যে এই রূপান্তরকে বংশগতীয় সঙ্কেত বলে।
বংশাণুবিজ্ঞানের এই ব্যাপক অগ্রগতির পর নতুন গবেষণার স্বর্ণদুয়ার খুলে যায়। এদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি গবেষণা ছিলো ১৯৭৭ সালে ফ্রেডেরিক স্যাঙ্গারের ডিএনএ সিকুয়েন্সিং এর শৃংখল-পরিসমাপ্তি: এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা ডিএনএ অণুর নিউক্লিওটাইড অনুক্রম পড়তে সক্ষম হন। [১৬] ১৯৮৩ সালে ক্যারি ব্যাংকস মুলিস পলিমারেজ শৃংখল বিক্রিয়া উদ্ভাবন করেন, যা কোন মিশ্রণ থেকে ডিএনএ'র নির্দিষ্ট অংশ আলাদা করার দ্রুত পথ দেখায়। [১৭] মানব বংশাণুসমগ্র প্রজেক্ট এর সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং পাশাপাশি সেলেরা বংশাণুসমগ্রিক্সের কাজ এবং অন্যান্য কৌশলের মাধ্যমে ২০০৩ সালে মানুষের বংশাণুসমগ্রের নীলনকশা তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়।[১৮]
সবচেয়ে প্রাথমিক স্তরে বংশ হতে বংশান্তরে জীবদেহে বৈশিষ্ট্য স্থানান্তরিত হয় বংশাণুর মাধ্যমে। [১৯] এই বৈশিষ্ট্যটি প্রথম আবিষ্কার করেন গ্রেগর মেন্ডেল, যখন তিনি মটরশুটিঁর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য পরবর্তী প্রজন্মে পৃথক হয়ে যাওয়া পর্যবেক্ষণ করছিলেন। [৪][২০] ফুলের রঙ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সময় মেন্ডেল লক্ষ্য করেন যে মটরশুটিঁ ফুলের রঙ হয় সাদা নয়তো বেগুনি হয়, তবে এদের মাঝামাঝি কিছু হয় না। একই বংশাণুর এই ভিন্ন, বিছিন্ন রূপকে অ্যালিল বলে।
মটরশুটিঁর ক্ষেত্রে, যা কিনা একটি ডিপ্লয়েড প্রজাতি, প্রতিট স্বতন্ত্র উদ্ভিদের প্রত্যেক বংশাণুর দুটি করে অ্যালিল আছে, যার প্রতিটি পিতা-মাতার কোন একজন থেকে এসেছে। [২১] অনেক প্রজাতি, যার মধ্যে মানুষও আছে, বংশগতির এই রূপ অনুসরণ করে। ডিপ্লয়েড জীবে দুটি একই রকম অ্যালিল যুক্ত বংশাণুকে ওই বংশাণু লোকাসে হোমোজাইগাস বলে, আর ভিন্ন অ্যালিল যুক্ত বংশাণুকে হেটারোজাইগাস বলা হয়।
কোন নির্দিষ্ট জীবের অ্যালিলগুচ্ছকে তার বংশাণুোটাইপ বলে, আর তার পর্যবেক্ষণযোগ্য বৈশিষ্ট্যসমূহকে তার ফিনোটাইপ বলে। কোন একটি বংশাণুতে হেটারোজাইগাস জীবের একটি বংশাণুকে সাধারণতঃ প্রকট বংশাণু বলা হয়, কারণ এর বৈশিষ্ট্যই ওই জীবের ফিনোটাইপে প্রাধান্য বিস্তার করে, অপরদিকে অন্য অ্যালিলটিকে প্রচ্ছন্ন বংশাণু বলে,কারণ তা ওই জীবটির ফিনোটাইপে প্রকাশিত হয় না। কিছু অ্যালিলে সম্পূর্ণ প্রকটতা দেখা যায় না, বরং তারা অসম্পূর্ণ প্রকটতা দেখায়, যাতে একটি মধ্যবর্তী ফিনোটাইপের সৃষ্টি হয়, অথবা সহপ্রকটতার সৃষ্টি হয়। [২২]
যখন এক জোড়া জীবে যৌন প্রজনন হয় তখন তাদের সন্তানাদি তাদের প্রত্যেকের দুটি অ্যালিল হতে একটি অ্যালিলের অধিকারী হয়। উত্তরাধিকারের এই বিচ্ছিন্নতা এবং অ্যালিলের আলাদা হয়ে যাবার এই ঘটনাটিকে মেন্ডেলের প্রথম সূত্র বা বিচ্ছিন্নতার সূত্র বলে।
বংশাণুবিজ্ঞানীরা বংশগতি বর্ণনা করতে ডায়াগ্রাম ও চার্ট ব্যবহার করেন। একটি বংশাণুকে একটি বর্ণ (অথবা একাধিক বর্ণ) দ্বারা প্রকাশ করা হয়-বড় হাতের বর্ণ প্রকট অ্যালিল নির্দেশ করে আর ছোট হাতের বর্ণ প্রচ্ছন্ন অ্যালিলকে নির্দেশ করে। [২৩] অনেক সময় কোন বংশাণুর সাধারণ, নন-মিউট্যান্ট অ্যালিল বোঝাতে একটি "+" চিহ্ন ব্যবহার করা হয়।
নিষেক ও প্রজনন সংক্রান্ত পরীক্ষণ গুলোতে (এবং বিশেষ করে মেন্ডেলের নিয়মগুলো নিয়ে আলোচনা করার সময়) পিতা-মাতাকে "P" প্রজন্ম দ্বারা চিহ্নিত করা হয় এবং তাদের সন্তানাদিকে "F1" (প্রথম প্রজন্ম) দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। যখন "F1" প্রজন্ম পরস্পরের সাথে মিলিত হয়ে সন্তান উৎপাদন করে তখন তাকে "F2" (দ্বিতীয় প্রজন্ম) বলা হয়। সঙ্কর প্রজননের ফলাফল দেখাবার জন্যে ব্যবহৃত একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি হল প্রুনেট বর্গ।
মানুষের বংশাণুগত রোগ নিয়ে গবেষণার সময় বিজ্ঞানীরা কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকার বোঝাতে পেডিগ্রি চার্ট ব্যবহার করেন। [২৪] এই চার্ট থেকে কোন বংশতালিকায় একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের বংশগতি লক্ষ্য করা যায়।
মানুষের বংশাণুগত রোগ নিয়ে গবেষণার সময় বিজ্ঞানীরা কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকার বোঝাতে পেডিগ্রি চার্ট ব্যবহার করেন। [২৪] এই চার্ট থেকে কোন বংশতালিকায় একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের বংশগতি লক্ষ্য করা যায়।
কোন জীবের হাজার হাজার বংশাণু থাকে, আর যৌন প্রজনন হওয়া জীবসমূহে এই বংশাণুসমূহের বিন্যাস সাধারণত পরস্পর স্বাধীনভাবে হয়। এই কথাটির মানে হল মটরশুঁটির হলুদ বা সবুজ রঙের অ্যালিলের উত্তরাধিকারের সাথে তার সাদা বা বেগুনি ফুলের উত্তরাধিকারের কোন সম্পর্ক নেই। এই ব্যাপারটিকে মেন্ডেলের দ্বিতীয় সূত্র বা স্বাধীনভাবে সঞ্চারণ সূত্র বলে, যার মানে হল পিতা-মাতার বিভিন্ন বংশাণুর অ্যালিল দৈবচয়ন ভিত্তিতে মিশ্রিত হয়ে নানান রকম বিন্যাস সংবলিত সন্তানাদির জন্ম দেয়। (কিছু বংশাণু সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে সঞ্চারিত হয় না, বরং বংশাণুগত লিংকেজ প্রদর্শন করে যা এই নিবন্ধে পরবর্তীতে আলোচনা করা হয়েছে।)
প্রায়ই একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য একাধিক বংশাণু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন ব্লু-আইড মেরিতে এমন একটা বংশাণু আছে যার অ্যালিল ফুলের রঙ নীল বা বেগুনি নির্ধারণ করে। আবার এতে আরেকটি বংশাণু আছে যা কিনা একই কাজ করে: সেটি ফুলের রঙ্গিন বা বর্ণহীন হওয়া নির্ধারণ করে। যখন একটি উদ্ভিদের এই বর্ণহীন বংশাণুর দুটি অ্যালিল থাকলে ফুলটি সাদাই হয়, অপর বংশাণুতে যাই থাকুক না কেন। একটি বংশাণুর অপর বংশাণুর বৈশিষ্ট্য বাধা দানের এই ব্যাপারটি এপিস্ট্যাসিস নামে পরিচিত, যেখানে দ্বিতীয় বংশাণুটি প্রথম বংশাণুর প্রতি এপিস্ট্যাটিক। [২৫]
অনেক বৈশিষ্ট্যই (যেমন সাদা আর বেগুনি ফুল) কোন একটা একক বংশাণুর নিয়ন্ত্রণাধীন বিচ্ছিন্ন গুণ নয়, বরং এগুলো অবিচ্ছিন্ন বৈশিষ্ট্য (যেমন মানুষের গায়ের রঙ, উচ্চতা ইত্যাদি) এই জটিল বৈশিষ্ট্যগুলো অনেক কয়টি বংশাণুর মিলিত বহিঃপ্রকাশ। [২৬] এই বংশাণুগুলোর প্রভাব অনেক উপাদান দ্বারাই প্রভাবিত হয়, বিশেষতঃ পরিবেশের নানান উপাদান দ্বারা। কোন একটি জটিল বৈশিষ্ট্যে কোন বংশাণুর অবদানের পরিমাণকে ঐ বংশাণুর হেরিটিবিলিটি বলে। [২৭] কোন একটি বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকার আপেক্ষিক - দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিবেশে পরিবেশ কোন আচরণের পরিবর্তনে উল্লেখযগ্য ভূমিকা রাখে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় মানুষের উচ্চতা একটি জটিল বৈশিষ্ট্য, আমেরিকাতে যার উত্তরাধিকার ৮৯%। তবে নাইজেরিয়া, যেখানে অপুষ্টির হার অনেক বেশি, সে দেশে এই পরিমাণটি গিয়ে দাঁড়ায় ৬২% এ। [২৮]
বংশাণুর আণবিক ভিত্তি হল ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিয়িক এসিড (ডিএনএ)। ডিএনএ নিউক্লিওটিডের শৃংখলে তৈরি, যা আবার চার ধরনের: এডেনিন(A), সাইটোসিন(C), গুয়ানিন(G) ও থাইমিন(T)। ডিএনএতে বংশাণুগত তথ্য এই নিউক্লিওটিডগুলোর বিন্যাসের ওপর নির্ভরশীল আর বংশাণু ডিএনএ শৃংখলে ক্রমান্বয়ে সজ্জিত থাকে। [২৯] একমাত্র "ভাইরাসই এই নিয়মের ব্যতিক্রম - এর বংশাণুগত তথ্য আরএনএতেও তৈরি হতে পারে। [৩০]
ডিএনএ সাধারণভাবে একটি দ্বি-সূত্রক তন্তু, যা কিনা পাকানো দ্বি-সর্পিল অবস্থায় থাকে। ডিএনএ'র প্রতিটি নিউক্লিওটাইড অপর তন্তুতে অবস্থিত তার সহযোগী নিউক্লিওটাইডের সাথে বন্ধনযুক্ত হয়: A জোট বাঁধে T এর সাথে, আর G, C এর সাথে। এভাবে তৈরি দ্বি-সর্পিল আকারে প্রতিটি সূত্রকেই তার পরিপূরক সূত্রকের প্রয়োজনাতিরিক্ত হয়ে সকল প্রয়োজনীয় তথ্য সংরক্ষণ করে। ডিএনএ'র গঠনই বংশগতির ভৌত ভিত্তি: ডিএনএ দ্বিত্বকরণের মাধ্যমে বংশাণুগত তথ্য প্রতিলিপি করা হয়, যখন সূত্রকদুটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে প্রতিটি সুতোই নিজের পরিপূরক সুতো তৈরির ছাঁচের মতো কাজ করে। [৩১]
ডিএনএ সূত্রকে বংশাণু মাত্রিকভাবে সজ্জিত থাকে, যাকে ক্রোমোসোম বলে। ব্যাকটেরিয়াতে প্রতিটি কোষেই একক বৃত্তাকার ক্রোমোসোম থাকে, যেখানে সুকেন্দ্রিক জীবে (যার মধ্যে উদ্ভিদ ও প্রাণী অন্তর্ভুক্ত) বহু সংখ্যক মাত্রিক ক্রোমোসোমে ডিএনএ সজ্জিত থাকে। এই ডিএনএ সূত্রকগুলো অনেক লম্বা হয়; উদাহরণস্বরূপ বলা যায় মানুষের দীর্ঘতম ক্রোমোসোম প্রায় ২৪৭ মিলিয়ন ক্ষার-জোড়া (base pair) নিয়ে গঠিত। [৩২] কোন ক্রোমোসোমে অবস্থিত ডিএনএ তার গাঠনিক প্রোটিনের সাথে সম্পর্কযুক্ত, যা তাকে সংগঠিত ও বিন্যস্ত রাখে এবং ডিএনএ'র সাথে যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ করে, যা কিনা ক্রোমাটিন নামক একটি পদার্থের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়; সুকেন্দ্রিক জীবে ক্রোমাটিন সাধারণতঃ নিউক্লিওসোমে তৈরি হয়, যা হল হিস্টোন প্রোটিনের কোরের (core) চারপাশে ডিএনএ পেঁচিয়ে তৈরি হয়। [৩৩] কোন জীবের বংশগতিগত পদার্থের সম্পূর্ণ সেটকে (সাধারণতঃ সব ক্রোমোসোমের সম্মিলিত ডিএনএ অনুক্রম) বংশাণুসমগ্র বলা হয়।
যেখানে হ্যাপ্লয়েড জীবের একটি ক্রোমোসোমের কেবল একবারই থাকে সেখানে অনেক ডিপ্লয়েড জীবের (উদ্ভিদ ও প্রাণী) প্রতিটি ক্রোমোসোম দুবার করে আছে, ফলে তাদের প্রতিটি বংশাণুরও দুটি প্রতিলিপি আছে। [৩৪] কোন বংশাণুর অ্যালিলদ্বয় অপত্য ক্রোমাটিডের সদৃশ লোকাইতে অবস্থান করে, আর প্রতিটি অ্যালিল প্রত্যেক পূর্বপুরুষের (পিতা বা মাতা) কাছ থেকে আসে।
সেক্স ক্রোমোসোম একটি ব্যতিক্রমধর্মী ক্রোমোসোম, অনেক প্রাণীর লিঙ্গ নির্ধারণে বিশেষ কিছু ক্রোমসোমের ভূমিকা আছে। [৩৫] মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীতে Y ক্রোমোসোমে অল্প কিছু বংশাণু থাকে এবং এটি পুরুষ লিঙ্গিক বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটায়, যেখানে X ক্রোমোসোম অন্যান্য ক্রোমোসোমের মতই অনেক বংশাণু বহন করে, যার অনেকগুলোর সাথে লিঙ্গ নির্ধারণের কোন সম্পর্ক নেই। মেয়েদের X ক্রোমোসোমের দুটি প্রতিলিপি থাকে, যেখানে ছেলেদের একটি X ও একটি Y ক্রোমোসোম থাকে - X ক্রোমোসোমের প্রতিলিপি সংখ্যার এই পার্থক্যই সেক্স -লিঙ্কড ডিজঅর্ডারের মত অস্বাভাবিক বংশগতির নমুনা সূত্রপাত করে।
কোষ বিভাজিত হবার সময় তাদের বংশাণুসমগ্র প্রতিলিপি করা হয় এবং প্রতিটি অপত্য কোষ একটি প্রতিলিপির অধিকারী হয়। এই প্রক্রিয়াটি মাইটোসিস নামে পরিচিত এবং প্রজননের এই সরলতম প্রক্রিয়াটিই অযৌন প্রজননের ভিত্তি। বহুকোষী জীবেও অযৌন প্রজনন ঘটতে পারে, যা কেবলমাত্র পিতা বা মাতার একজনের বংশাণুসমগ্র বিশিষ্ট সন্তানের জন্ম দেয়। পূর্বপুরুষের হুবহু বৈশিষ্ট্য সংবলিত সন্তান ক্লোন হিসেবে পরিচিত।
সুকেন্দ্রীক জীবে যৌন প্রজনন হয়, যে প্রক্রিয়ায় সন্তান পিতা-মাতার বংশাণুগত বস্তুর মিশ্রণের উত্তরাধিকারী হয়। যৌন প্রজননের প্রক্রিয়াটি বংশাণুসমগ্রের একটি প্রতিলিপি বিশিষ্ট হ্যাপ্লয়েড ও দুটি প্রতিলিপি বিশিষ্ট ডিপ্লয়েড অবস্থার পরিবর্তনের মাধ্যমে ঘটে। হ্যাপ্লয়েড কোষ গুলো একত্রিত হয় এবং এদের বংশাণুগত বস্তুর মিলনে ডিপ্লয়েড কোষ সৃষ্টি হয়। ডিপ্লয়েড কোষ ডিএনএ দ্বিত্বঃকরণ ছাড়াই ভাগ হয়ে গিয়ে হ্যাপ্লয়েড কোষ তৈরি করে এবং এই প্রক্রিয়ায় অপত্য কোষ দৈব চয়ন ভিত্তিতে প্রতি জোড়া ক্রোমোসোমের যে কোন একটির উত্তরাধিকারী হয়। বেশির ভাগ উদ্ভিদ ও প্রাণীই ডিপ্লয়েড, যেখানে তাদের একক কোষে তৈরি গ্যামিট হ্যাপ্লয়েড।
হ্যাপ্লয়েড বা ডিপ্লয়েড পদ্ধতির যৌন প্রজনন না হলেও ব্যাকটেরিয়ার নতুন বংশাণুগত বৈশিষ্টের অধিকারী হয়বার অনেক পন্থা আছে। কিছু ব্যাকটেরিয়া কনজুগেশন এর মাধ্যমে অপর ব্যাকটেরিয়াতে ক্ষুদ্র বৃত্তাকার ডিএনএ খন্ড পাঠাতে পারে। [৩৬] ব্যাকটেরিয়া পরিবেশ থেকেও ডিএনএ তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ করে তা বংশাণুসমগ্রে রূপান্তরিত করতে সক্ষম, যা কিনা রূপান্তর নামে পরিচিত। [৩৭] এই প্রক্রিয়াগুলো সমান্তরাল বংশাণু স্থানান্তর ঘটায়, যার মাধ্যমে এমনিতে সম্পর্কহীন জীবে বংশাণুগত তথ্যের আদান-প্রদান হয়।
ক্রোমোসোমের ডিপ্লয়েড চরিত্র বিভিন্ন ক্রোমোসোমকে যৌন প্রজননের সময় স্বাধীনভাবে সঞ্চারিত হতে দেয়, যা বংশাণুর নতুন নতুন সমাবেশ সৃষ্টি করে। তত্ত্বীয়ভাবে একই ক্রোমোসোমে অবস্থিত বংশাণুর রিকবিনেশন হবার কথা নয়, তবে ক্রোমোসোমাল ক্রসওভার এর কারণে তা ঘটে থাকে। ক্রসওভারের সময় ক্রোমোসোম ডিএনএ'র খন্ড স্থানান্তর করে, এভাবেই ক্রোমোসোমের মধ্যে বংশাণুর অ্যালিল আদান-প্রদান হয়। [৩৮] ক্রোমোসোমাল ক্রসওভারের ব্যাপারটি ঘটে সাধারণতঃ মিয়োসিস বিভাজনের সময়, যা হ্যাপ্লয়েড কোষ তৈরি করে।
ক্রোমোসোমের দুটি নির্দিষ্ট বিন্দুর মধ্যে ক্রোমোসোমাল ক্রসওভার ঘটার সম্ভাবনা তাদের মধ্যে (বিন্দু দুটির) দূরত্বের ওপর নির্ভর করে। কোন একটি বড় দূরত্বের জন্যে ক্রসওভারের সম্ভাবনা এত বেশি থাকে যে বংশাণুর উত্তরাধিকার কার্যকরবভাবে সম্পর্কহীন থাকে। যেসন বংশাণু কাছাকাছি থাকে, যদিও ক্রসওভারের স্বল্প সম্ভাবনা এটা নির্দেশ করে যে বংশাণুগুলো বংশাণুগত লিংকেজ প্রদর্শন করে - দুটি বংশাণুর অ্যালিল একসাথে উত্তরসূরিতে যেতে চায়। এক গুচ্ছ বংশাণুর জন্যে লিংকেজের পরিমাণ একত্রিত হয়ে রৈখিক লিংকেজ ম্যাপ সৃষ্টি করে যা কোন ক্রোমোসোমে বংশাণুর বিন্যাসের একটি প্রাথমিক ধারণা প্রদান করে। [৩৯]
বংশাণু সাধারণতঃ প্রোটিন তৈরির মাধ্যমে তাদের প্রকাশ ঘটায়, যেটি কিনা কোষের সবচেয়ে জটিল কাজগূলো সম্পাদনকারী অণু। প্রোটিন হল অ্যামিনো অ্যাসিডের শৃঙ্খল, আর বংশাণুর ডিএনএ ক্রম (আরএনএ অন্তবর্তীর মাধ্যমে) সুনির্দিষ্ট প্রোটিন ক্রম তৈরির জন্যে ব্যবহৃত হয়। এই প্রক্রিয়াটি বংশাণুর ডিএনএ ক্রমের সাথে মিল থাকা আরএনএ অণু তৈরির মাধ্যমে আরম্ভ হয়, যে প্রক্রিয়াটি প্রতিলিপিকরণ (transcription) নামে পরিচিত।
এই বার্তাবাহক আরএনএ অণুটি অতঃপর সংশ্লিষ্ট ক্রমিক অ্যামিনো অ্যাসিড উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়, যে প্রক্রিয়াটি ট্রান্সলেশন নামে পরিচিত। প্রতিটি গ্রুপে তিনটি নিউক্লিওটাইডের ক্রম থাকে, যাকে কোডন বলা হয়, যা কিনা প্রোটিনের সম্ভাব্য বিশটি অ্যামিনো অ্যাসিডের একটির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয় - এই যোগাযোগ বংশগতীয় সঙ্কেত নামে পরিচিত। [৪০] তথ্যের প্রবাহ হয় দিক-অনির্দিষ্ট, তথ্য নিউক্লিওটাইডের অনুক্রম থেকে অ্যামিনো অ্যাসিডের অনুক্রম প্রোটিনে স্থানান্তরিত হয়, কিন্তু এটি কখনো প্রোটিন থেকে ডিএনএ অনুক্রমের দিকে ফেরত যায় না, ফ্রান্সিস ক্রিক যাকে বলেছিলেন আণবিক জীববিদ্যার কেন্দ্রীয় মতবাদ। [৪১]
অ্যামিনো এসিডের সুনির্দিষ্ট অনুক্রমের কারণেই প্রোটিনের স্বতন্ত্র ত্রি-মাত্রিক কাঠামো তৈরি হয়,আর এই ত্রি-মাত্রিক কাঠামোর সাথে এর কাজের সম্পর্ক রয়েছে। [৪২][৪৩] কিছু হল সরল গাঠনিক অণু, যেমন প্রোটিন কোলাজেন দ্বারা গঠিত তন্তু। প্রোটিন অন্য প্রোটিন এবং সরল অণুর সাথে যুক্ত হতে পারে এবং কখনো কখনো তা এনজাইমের মত কাজ করে রাসায়নিক বিক্রিয়াকে প্রভাবিত করে (নিজের প্রোটিন গঠন পরিবর্তন না করে)। প্রোটিনের গঠন পরিবর্তনশীল; প্রোটিনের হিমোগ্লোবিন বিভিন্ন রূপে পরিবর্তিত হয় এবং স্তন্যপায়ীর রক্তে অক্সিজেন সংগ্রহ, পরিবহন, এবং পরিত্যাগের কাজগুলো করে।
ডিএনএতে একটিমাত্র নিউক্লিওটিডের অ্যামিনো এসিডের ক্রমেও একটি পরিবর্তন ঘটায়। যেহেতু প্রোটিন অ্যামিনো এসিডের শিকল দ্বারা তৈরি তাই এর কোন পরিবর্তন প্রোটিনে নাটকীয় পরিবর্তন আন্তে পারে; প্রোটিন পৃষ্ঠের এমন কোন পরিবর্তন ঘটতে পারে যে তা অন্য প্রোটিন ও অণুর সাথে বন্ধন তৈরির ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে। যেমন, সিকল-সেল এনিমিয়া হল একটি বংশাণুগত অসুখ যা হিমোগ্লোবিনের β-গ্লোবিন সঙ্কেতায়ন অঞ্চলে একটি বেস পরিবর্তনের কারণে ঘটে, যার ফলে একটি অ্যামিনো এসিডের পরিবর্তন ঘটে যা হিমোগ্লোবিনের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে। [৪৪] সিকল সেল আক্রান্ত হিমোগ্লোবিন নিজেদের সাথে লেগে থাকে, যা তন্তুময় গঠন সৃষ্টি করে যার ফলে লোহিত রক্ত কণিকাবাহী প্রোটিনের আকার বিকৃত হয়ে যায়। তখন এই কাস্তে আকৃতির হিমোগ্লোবিন আর আগের মত রক্ত নালীর মধ্য দিয়ে স্বচ্ছন্দ্যে চলতে পারে না, এরা জমাট বাঁধে বা বিকৃত হয়ে যাবার প্রবণতা দেখায়, যার ফলে এই অসুখের সাথে জড়িত সমস্যাগুলো দেখা দেয়।
কিছু বংশাণু আরএনএতে থাকে কিন্তু তারা প্রোটিন উৎপাদে রূপান্তরিত হয় না - এদের বলা হয় অ-সঙ্কেতায়ক আরএনএ অণু। কিছু ক্ষেত্রে এরা একত্র হয়ে এমন গঠন তৈরি করে যা কোষের জটিল ক্রিয়াগুলো (যেমন: রাইবোজোমীয় আরএনএ এবং হস্তান্তর আরএনএ) সম্পাদন করে। আরএনএ অন্য আরএনএ'র সাথে সংকরণ মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রক প্রভাব সৃষ্টি করে (যেমন: অণু-আরএনএ)।
যদিও বংশাণু কোন জীবের সব প্রয়োজনীয় তথ্য জমা করে রাখে, চূড়ান্ত ফিনোটাইপ নির্ধারণে পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে - এই দ্বৈততাকে অনেক সময় "প্রকৃতির স্ববিরোধ" বলা হয়। কোন জীবের ফিনোটাইপ বংশাণুবিজ্ঞানের সাথে পরিপ্বার্শের মিথস্ক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে। এর একটি উদাহরণ হল তাপমাত্রা-সংবেদী মিউটেশান। প্রায়ই একটি অ্যামিনো এসিডের পরিবর্তন প্রোটিনের গঠন ও অন্যান্য অণুর সাথে তার পারস্পরিক ক্রিয়ার পরিবর্তন করে না, তবে এটি ঠিকই তার গঠন অস্থিতিশীল করে তোলে। উচ্চ তাপমাত্রার পরিবেশে, যখন অণুগুলো খুব দ্রুত ছুটোছুটি করে আর পরষ্পরের সাথে সংঘর্ষ ঘটায়, তখন প্রোটিন তার গঠন হারিয়ে ফেলে এবং এর কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। তবে নিম্ন তাপমাত্রায় তা স্বাভাবিকভাবেই নিজের কাজ সম্পন করে।সিয়ামিজ বিড়ালের পশমের রং নির্ধারণী বংশাণুতে এ ধরনের মিউটেশান লক্ষ্য করা যায়, যখন পিগমেন্ট তৈরিকারী একটি এনজাইমে মিউটেশানের ফলে তা অস্থিতিশীল হয়ে যায় এবং উচ্চ তাপমাত্রায় কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। [৪৫] প্রোটিনটি ত্বকের অপেক্ষাকৃত শীতল অংশগুলোতে (পা, কান, লেজ এবং মুখমন্ডলে) ভালোভাবেই কাজ করে - ফলে উচ্চ তাপমাত্রাবিশিষ্ট অংশগুলোতে এর লোম হয় গাঢ় বর্ণের।
পরিবেশ মানুষের বংশগতিমূলক রোগ ফিনাইলকিটোনিউরিয়ালের প্রভাবেও নাটকীয় ভূমিকা পালন করে। [৪৬] যে মিউটেশানের কারণে ফিনাইলকিটোনিউরিয়াল শরীরের ফিনাইলঅ্যালানিন নামক অ্যামিনো এসিডটি ভাঙ্গার ক্ষমতা বাধাগ্রস্ত করে, যার ফলে একটি ক্ষতিকর অন্তবর্তী অণু তৈরি হয়, তা পালাক্রমে অগ্রসর মানসিক শ্লথতা ও প্যারালাইসিসের উপসর্গ সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফিনাইলকিটোনিউরিয়াল মিউটেশান আছে এমন রোগী যদি কঠোরভাবে অ্যামিনো এসিড যুক্ত খাবার এড়িয়ে চলেন, তবে তিনি সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন।
কোন নির্দিষ্ট জীবের বংশাণুসমগ্র হাজার হাজার বংশাণু ধারণ করে, তবে কোন নির্দিষ্ট সময়ে তাদের সবাইকেই যে সক্রিয় থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই। বংশাণু তখনই প্রকাশিত হয় যখন তা mRNA তে রূপান্তরিত হয় (এবং এর মাধ্যমে প্রোটিনে রূপান্তরিত হয়), বংশাণুর অভিব্যক্তি নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেকগুলো কোষগত পদ্ধতি আছে যার মাধ্যমে কেবল প্রয়োজনের সময়ই বংশাণুকে প্রকাশিত হতে দেওয়া হয়। ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর হল নিয়ন্ত্রক প্রোটিন, যা বংশাণুর শুরুতে অবস্থান করে এর প্রকাশ নিয়ন্ত্রণ করে।[৪৭] উদাহরণস্বরূপ, ইশেরিকিয়া কোলাই ব্যকটেরিয়াতে ট্রিপটোফেন নামক অ্যামিনো অ্যাসিড সংশ্লেষের জন্যে প্রয়োজনীয় বংশাণুর সমাবেশ বিদ্যমান। কিন্তু কোষে যখন ট্রিপটোফেনের অভাব নেই তখন আর ওই বংশাণুটির কার্যকারিতা কাঙ্ক্ষিত নয়। ট্রিপটোফেনের উপস্থিতি বংশাণুর কার্যক্রমকে সরাসরি ব্যাহত করে— ট্রিপটোফেন অণু ট্রিপটোফেন রিপ্রেসরের সাথে যুক্ত হয়, যা রিপ্রেসরের গঠন এমনভাবে পরিবর্তন করে যে তা বংশাণুর সাথে সংযুক্ত হয়ে যায়। ট্রিপটোফেন রিপ্রেসর অনুলিপিকরণ বাধাগ্রস্ত করে দিয়ে বংশাণুর প্রকাশিত হবার পথ রুদ্ধ করে দেয়, যা ঋণাত্বক ফিডব্যাক সৃষ্টি করে বংশাণুর ট্রিপটোফেন সংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়।
বংশাণু অভিব্যক্তির ভিন্নতা বহুকোষী জীবে স্পষ্ট, যেখানে কোষগুলো একই বংশাণুসমগ্র ধারণ করে কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন কাঠামো ও আচরণের অধিকারী হয় যার কারণ হল তাদের মধ্যে প্রকাশিত বংশাণুর ভিন্নতা। একটি বহুকোষী জীবে সব কোষই একটি কোষ থেকে উৎপত্তি লাভ করে, কিন্তু এরা নানারকম কোষে ভাগ হয়ে যায় বহিঃস্থ ও আন্তঃকোষীয় সংকেতের কারণে এবং এভাবে ধীরে ধীরে এরা ভিন্ন ভিন্ন বংশাণু অভিব্যক্তির প্যাটার্ন তৈরি করে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করে থাকে। যেহেতু কোন একক বংশাণু বহুকোষী বংশাণুর উন্নয়নের জন্যে দায়ী নয়, তাই এই প্যাটার্নগুলো বহুসংখ্যক কোষের মধ্যে জটিল মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হয়।
ইউক্যারিয়টদের মধ্যে ক্রোমাটিনের কিছু বিশেষ গাঠনিক বৈশিষ্ট্য থাকে যা বংশাণুর প্রতিলিপিকরণকে প্রভাবিত করে, যা প্রায়শই ডিএনএ ও ক্রোমাটিনের পরিবর্তনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় যা কিনা তাদের অপত্য কোষগুলো দ্বারা দৃঢ়ভাবে অর্জিত হয়।[৪৮] এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে এপিজেনেটিক বলা হয় কারণ এরা ডিএনএ সিকুয়েন্সের ওপরে অবস্থান করে এবং এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বংশগতিসূত্রে স্থানান্তরিত হয়। এপিজেনেটিক বৈশিষ্ট্যের কারণে একই মাধ্যম থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন প্রকারের কোষ ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকারী হয়। যদিও এপিজেনেটিক বৈশিষ্ট্য সাধারণত গাঠনিক ধারায় গতিশীল একটি প্রক্রিয়া, এর মধ্যে কিছু, যেমন প্যারামিউটেশান এর ব্যাপারটির বহুপ্রজন্ম উত্তরাধিকারের অধিকারী এবং বংশগতির বাহক হিসেবে ডিএনএর ভিত্তির একটি দুর্লভ ব্যতিক্রম হিসেবে অবস্থান করছে।[৪৯]
ডিএনএ প্রতিলিপিকরণের সময় কালেভদ্রে দ্বিতীয় সূত্রকের শৃংখলকরণে ত্রুটি ঘটতে পারে। এই ভুলগুলো, যেগুলো কিনা রূপান্তর বা পরিব্যক্তি (মিউটেশন) নামে পরিচিত, কোন জীবের ফিনোটাইপের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে তা যদি বংশাণুর প্রোটিন সংকেতের ক্রমে ঘটে থাকে। এই ভুলের মাত্রা খুবই ছোট হয়ে থাকে— প্রতি ১০-১০০ মিলিয়ন বেসের মধ্যে ১ টি— ডিএনএ পলিমারেজের মুদ্রণ সংশোধন (প্রুফ-রিডিং) ক্ষমতার কারণে এটি সম্ভব হয়।[৫০][৫১](মুদ্রণ সংশোধন ক্ষমতা ব্যতীত ভুলের মাত্রা হাজার গুণ বেড়ে যায়; কারণ অনেক ভাইরাস ডিএনএ ও আরএনএ পলিমারেজের সীমাবদ্ধ প্রুফ-রিডিং ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে; যার ফলে তারা দ্রুত রূপান্তরিত হতে পারে।) যেসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ডিএনএতে পরিবর্তনের হার বৃদ্ধি পায় সেগুলোকে মিউটাজেনিক বলা হয়; মিউটাজেনিক রাসায়নিক যৌগ ডিএনএ রেপ্লিকেশনে ভুলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, প্রায়শই বেস-পেয়ারের কাঠামোতে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে, যখন অতিবেগুনি তেজস্ক্রিয়তা মিউটেশনের হার বাড়ায় ডিএনএ কাঠামোর ক্ষতি করে।[৫২] ডিএনএতে স্বাভাবিকভাবে রাসায়নিক ত্রুটিও ঘটে থাকে, এবং যদিও কোষের ডিএনএ মেরামত কৌশল ভুল সংযোগ ও ভাঙ্গা অংশ জোড়া দেবার কাজ করে থাকে, কোন কোন সময় এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং ডিএনএ তার পূর্বের গঠনে ফিরে যেতে পারে না।
যেসব জীব ক্রোমোসমাল ক্রসওভারের মাধ্যমে ডিএনএ আদান-প্রদান ও বংশাণু পুনঃসংযোগ করে থাকে, মিয়োসিসের সময় সারিবদ্ধকরণের ত্রুটির ফলে তাদের রূপান্তর ঘটতে পারে।[৫৩] ক্রসওভারের সময় ভুলের সম্ভাবনা বেশি হয় যখন অনুরোপ ক্রমের কারণে অংশীদার ক্রোমসোম ভুলভাবে বিন্যস্ত হয়; এর ফলে বংশাণুসমগ্রের কিছু এলাকায় মিউটেশন হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এই ত্রুটি থেকে ডিএনএ সিকুয়েন্সে বড় ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটতে পারে— সম্পূর্ণ এলাকার প্রতিলিপিকরণ, ইনভার্সন অথবা বিনষ্টকরণ, অথবা বিভিন্ন ক্রোমোসোমের মধ্যে দুর্ঘটনাবশত পুরো অংশ বিনিময় (যাকে বলা হয় ক্রোমোসোমাল ট্রান্সলোকেশন)।
রূপান্তরের মাধ্যমে ভিন্ন বংশাণুোটাইপ বিশিষ্ট জীব তৈরি হয়, এবং এই পরিবর্তনের ফলে ফিনোটাইপও পরিবর্তিত হয়। বহু সংখ্যক রূপান্তরও একটি জীবের ফিনোটাইপ, স্বাস্থ্য এবং প্রজনন উপযোগীতার ওপর অল্পই প্রভাব ফেলতে পারে। যেসব রূপান্তর প্রকৃতপক্ষে প্রভাব ফেলতে পারে তার সাধারণত ক্ষতিকর হয়ে থাকে, তবে কখনো কখনো রূপান্তর উপকারীও হতে পারে। ড্রোসোফিলা মেলানোজাস্টার মাছিতে করা গবেষণা থেকে জানা যায় যদি রূপান্তরের মাধ্যমে বংশাণুর তৈরিকৃত প্রোটিন পরিবর্তিত হয়ে যায়, তবে খুব সম্ভবতঃ তা ক্ষতিকর হবে, কারণ শতকরা ৭০ ভাগ রূপান্তরই ক্ষতকর হয়, এবং অবশিষ্টাংশ হয় নিরপেক্ষ নয়তো স্বল্পভাবে উপকারী হয়।[৫৪]
জনসংখ্যা বংশাণুবিজ্ঞান গবেষণা কোন জনগোষ্ঠীর মধ্যে বংশাণুগত পরিবর্তন এবং কীভাবে সময়ের সাথে এর বণ্টন পরিবর্তিত হয় তা অনুসন্ধান করে।[৫৫] কোন জনসমষ্টিতে অ্যালিল কম্পাংক প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে, যেখানে একটি অ্যালিলের টিকে থাকার উচ্চ ক্ষমতা এবং প্রজনন ঐ জনসমষ্টিতে এর উপস্থিতির হার বাড়িয়ে দেয়।
বহু প্রজন্মান্তরে জীবের বংশাণুসমগ্র পরিবর্তিত হয়ে বিবর্তন ঘটাতে পারে। রূপান্তর ও লাভজনক রূপান্তরের নির্বাচন একটি প্রজাতিকে বিবর্তিত করে পরিবেশে আরো ভালোভাবে টিকে থাকার উপযোগী করে তুলতে পারে, যা অভিযোজন নামে পরিচিত।[৫৬]প্রজাত্যায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নউন প্রজাতির সৃষ্টি হয়, এই প্রক্রিয়াটি প্রায়শই ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার সাথে জড়িত যা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে বংশাণুগত পরিবর্তনের সুযোগ দেয়।[৫৭] পপুলেশন বায়োলজি ও বিবর্তনে বংশাণুগত নীতিগুলোর প্রয়োগকে আধুনিক সংশ্লেষ বলা হয়।
যেহেতু সিকুয়েন্স অপসারী হয় এবং বিবর্তনের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয় , সিকুয়েন্সের এই পরিবর্তন আণবিক ঘড়ি হিসেবে ব্যবহার করে তাদের মধ্যে বিবর্তনগত দূরত্ব পরিমাপ করা যায়।[৫৮] বংশাণুগত তুলনাই ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির মধ্যে সম্পর্কতা চরিত্রায়িত করার সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। এটি প্রায়শই ত্রুটিপূর্ণ ফিনোটাইপিক তুলনার একটি উৎকৃষ্ট প্রতিস্থাপন। প্রজাতির মধ্যে বিবর্তনগত দূরত্বের ভিত্তিতে বিবর্তন বৃক্ষ তৈরি করা হয় - এই বৃক্ষ সাধারণ বংশক্রমাগমের প্রতিনিধিত্ব করে এবং সময়ের সাথে প্রজাতির অপসারিতার পরিমাপ করে, যদিও এরা সম্বন্ধহীন প্রজাতির মধ্যে বংশাণুগত বস্তুর আদান-প্রদান দেখাতে পারে না (যা সমান্তরাল বংশাণু বদল নামে পরিচিত এবং ব্যাকটেরিয়াতে অহরহ ঘটে থাকে)।
যদিও বংশাণুতাত্ত্বিকরা সুপ্রচুরসংখ্যক জীবের বংশগতি নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন, গবেষকরা নির্দিষ্ট ধরনের কিছু জীবের বংশাণুবিজ্ঞানের ওপর বিশেষভাবে নজর দেন। এর কারণ হল কোন একটি জীবের ওপর যদি যথেষ্ট পরিমাণ কাজ করা হয়ে থাকে তবে পরবর্তীতে গবেষকরা ঐ বিষয়ে কাজ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ফলে বংশাণুতাত্ত্বিক গবেষণায় কিছু মডেল অর্গানিজমের ওপর গবেষণাই এই ক্ষেত্রে গবেষণার ভিত্তিতে পরিণত হয়েছে।[৫৯] মডেল বা আদর্শ জীবের ওপর করা প্রচলিত গবেষণার মধ্যে রয়েছে বংশাণু নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত কাজ এবং বিবর্তন ও ক্যান্সারে বংশাণুর ভূমিকা সংক্রান্ত গবেষণা।
গবেষণার জন্যে জীবের বাছাইকরণ আংশিকভাবে নির্ভর করে কিছু সুবিধার ওপরও — সংক্ষিপ্ত সংঘটন সময় এবং সহজ বংশাণুগত পরিচালনার কারণে কিছু জীব বংশাণুগত গবেষণায় বিপুল জনপ্রিয়। বহুল ব্যবহৃত মডেল জীবের মধ্যে রয়েছে ব্যাক্টেরিয়াম ইশেরেকিয়া কোলাই, উদ্ভিদ এরাবিডোপসিস থ্যালিয়ানা, ঈস্ট স্যাকারোমাইসিস সেরাভিসি, নেমাটোড ক্যানোরহ্যাবডিটিস এলিগানস, সাধারণ ফলের মাছি (ড্রোসোফিলা মেলানোজেস্টার), এবং গৃহস্থালির ইঁদুর (মাস মাস্কুলাস)।
চিকিৎসা বংশাণুবিজ্ঞান মানুষের স্বাস্থ্য ও রোগবালাইয়ের সাথে বংশাণুতাত্ত্বিক বৈচিত্রের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করে।[৬০] কোন রোগের সাথে জড়িত অজানা বংশাণু খুঁজে বের করার লক্ষ্যে গবেষকরা জেনেটিক লিংকেজ ও পেডিগ্রি ছক ব্যবহার করে বংশাণুসমগ্রে এর অবস্থান শনাক্ত করার চেষ্টা করেন। কোন জনগোষ্ঠীতে রোগের সাথে সম্পর্কিত বংশাণুসমগ্র খুঁজে বের করতে বিজ্ঞানীরা মেন্ডেলীয় রেন্ডমাইজেশানের সাহায্য নেন, যা কিনা বহুবংশাণুগত বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত হয়।[৬১] কোন সম্ভাব্য বংশাণু শনাক্ত করা গেলে মডেল জীবের ওপর পরবর্তী পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। বংশগতিমূলক রোগবালাই নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি বংশাণুোটাইপিক কৌশলের ক্রমবর্ধমান উদ্ভাবন ফার্মাকোগেনেটিক্স এর জন্ম দিয়েছে - যেখানে ওষুধের প্রতি বংশাণুোটাইপের সাড়া লক্ষ্য করা হয়।[৬২] উত্তরাধিকার সূত্রে না ছড়ালেও, ক্যান্সার এক প্রকার বংশগতিমূলক ব্যাধি।[৬৩] মানবশরীরে ক্যান্সার এর বিস্তৃতি বেশ কিছু সংখ্যক ঘটনার ফলাফল। কোষ বিভাজিত হবার সময় কালেভদ্রে পরিব্যক্তি ঘটে। এসব পরিব্যক্তি সন্তানাদিতে না পৌঁছালেও তা কোষের ব্যবহার কিছুটা বদলে দেয়, যার ফলে তাদের বৃদ্ধি ও বিভাজন দ্রুততর হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়া থামানোর জন্যে শরীরের এক ধরনের সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা থাকে: অযথাযথভাবে বিভাজিত কোষে বিশেষ সংকেত পাঠানো হয় যা তাদের কোষীয় মৃত্যু ত্বরান্বিত করে, কিন্তু মাঝে মাঝে কোষে এমন পরিব্যক্তি ঘটে যার পরিণামে এই সংকেত অগ্রাহ্য করা হয়। কোষের অভ্যন্তরে এভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোষসমূহ তাদের বৃদ্ধি নিশ্চিত করে, যা দেহে টিউমার তৈরি করে যার মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন কলা আক্রান্ত হয়।
ডিএনএ ল্যাবরেটরিতে ডিএনএ নিয়ে গবেষণা করা হয়। ডিএনএ নির্দিষ্ট সিকুয়েন্সে কর্তন করতে বহুল ব্যবহৃত একটি এনজাইম হল রেস্ট্রিকশন এনজাইম, যা ডিএনএকে পরিকল্পিতভাবে ভাগ করতে পারে।[৬৪] জেল ইলেকট্রোফোরেসিস প্রক্রিয়ায় ডিএনএ দেখা যায়। ডিএনএ খন্ডসমূহ তাদের দৈর্ঘ্য অনুযায়ী বিভক্ত হয়।
লাইগেশন এনজাইমের মাধ্যমে ডিএনএ খন্ডসমূহকে পুনঃর্যোজিত করা যেতে পারে এবং বিভিন্ন উৎস থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করে তাদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে গবেষকেরা রিকম্বিন্যান্ট ডিএনএ তৈরি করেন। রিকম্বিন্যান্ট ডিএনএ প্রযুক্তি সাধারণত প্লাজমিডের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে - যাদের স্বল্প কিছু ডিএনএ বিশিষ্ট বৃত্তাকার বংশাণু বিদ্যমান। এ ধরনের প্লাজমিডকে ব্যাক্টেরিয়ার অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়ে গবেষকেরা সেই প্রবেশকৃত ডিএনএ খন্ডকটুকুর সংখ্যাবৃদ্ধি করেন, যা কিনা আণবিক ক্লোনিং হিসেবে পরিচিত।
পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশনের মাধ্যমেও ডিএনএর সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটানো সম্ভব।[৬৫] ডিএনএর সুনির্দিষ্ট স্বল্প সিকোয়েন্সে পিসিআরের মাধ্যমে পৃথক করে বহুগুণ বর্ধিত করা যায়। ডিএনএর অতি ক্ষুদ্র অংশ বর্ধিত করতে পারে বিধায় নির্দিষ্ট ডিএনএ সিকোয়েন্সের উপস্থিতি নির্ধারণে পিসিআর বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি।
|middle=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)
|coauthors=
উপেক্ষা করা হয়েছে (|author=
ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য)