নারীবাদ |
---|
ধারাবাহিকের একটি অংশ |
মার্কসবাদ |
---|
একটি সিরিজের অংশ |
মার্ক্সীয় নারীবাদ হচ্ছে এক ধরনের নারীবাদ যা পুঁজিবাদ এবং ব্যক্তিমালিকানার ব্যবস্থায় নারী কীভাবে নির্যাতিত হচ্ছে তা তদন্ত ও ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে।[১] মার্ক্সীয় নারীবাদীদের মতে, নারীর স্বাধীনতা কেবল বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনীতির আমূলক সংস্কারমূলক পুনর্গঠনের দ্বারাই সম্ভব, যেই পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে নারীর বেশিরভাগ শ্রমেরই ক্ষতিপূরণ হয় না।[২]
মারগারেট বেনস্টন ও পেগি মরটনদের মত মার্ক্সিস্ট ফেমিনিস্টরা বলেন, ক্যাপিটালিস্ট সিস্টেমে দুই ধরনের শ্রম থাকে।[৩] এদের মধ্যে একটা হল প্রোডাক্টিভ বা উৎপাদনশীল, যেক্ষেত্রে ক্যাপিটালিস্ট সিস্টেমে এর উৎপাদিত পণ্য বা সেবার একটা আর্থিক মূল্য থাকে। আর তার ফলে উৎপাদনকারীর সেই শ্রমকে মজুরির মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ করা হয়। আরেকধরনের শ্রম হল আনপ্রোডাক্টিভ বা অনুৎপাদনশীল। এটা ব্যক্তিমালিকানাধীন জগতের সাথেই সম্পর্কিত। এই শ্রমের মধ্যে সেইসব শ্রম পড়বে, যেগুলো মানুষ তাদের নিজেদের জন্যই করে এবং সেখানে মজুরি পাবার কোন আকাঙ্ক্ষা থাকে না (যেমন ঘর পরিষ্কার করা, রান্না করা, সন্তান পালন করা)। উভয় ধরনের শ্রমই প্রয়োজনীয়। কিন্তু দেখা যায় এই বিভিন্ন ধরনের শ্রমের ক্ষেত্রে মানুষের অংশগ্রহণে পার্থক্য হয়। আর সেই পার্থক্য তার পরিচয়ের সাথে সম্পর্কিত, লিঙ্গ পরিচয়। নারীরা দেখা যায় গৃহস্থালি জগতে কাজ করে, যেখানে শ্রম হচ্ছে অনুৎপাদনশীল, আর তাই সেটা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় ক্ষতিপূরণ-অযোগ্য, অস্বীকৃত হয়ে থেকে যাচ্ছে। দেখা যায়, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্রাযত্ত ও ব্যক্তিমালিকানাধীন উভয় ধরনের সংস্থার স্বার্থেই শ্রমশক্তিকে খুব সস্তায় টিকিয়ে রাখার জন্য নারীর শ্রমকে কোনরকম মজুরি ছাড়াই ব্যবহার করা হয় ও নারীকে শোষণ করা হয়। আর এর মাধ্যমেই উৎপাদনকারী অধিক মুনাফা অর্জন করেন। নিউক্লিয়ার বা একক পরিবারে যে ক্ষমতা গতিবিদ্যা দেখা যায় তাতে গৃহস্থালী সমস্ত কাজই নারীর দ্বারা করানো হচ্ছে, আর এর মাধ্যমে পুরুষকে ঘরের কাজকর্ম থেকে মুক্ত রাখা হচ্ছে যাতে তাদের দ্বারা প্রয়োজনীয় উৎপাদনশীল কাজ করানো যায়। অধিক মুনাফার আশায় পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা এরকম ক্ষমতা গতিবিদ্যাকে নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। মার্ক্সীয় নারীবাদীরা বলেন, উৎপাদনশীল শ্রম থেকে নারীদেরকে বঞ্চিত করে ব্যক্তিমালিকানাধীন ও রাষ্টায়ত্ব- উভয় ক্ষেত্রেই পুরুষ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করা হয়।[৩][৪]
প্রতিবাদের প্রকৃতি এবং সামাজিক পরিবর্তনের উৎসাহদানে কাজ করার ক্ষমতার কারণে মার্ক্সীয় নারীবাদীরা তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে জড়িত হয়েছে। তাদের বিতর্কিত সমর্থন প্রায়ই তাদেরকে সমালোচনার মুখে পতিত করেছে। মার্ক্সীয় নারীবাদীরা পুঁজিবাদকে এমনভাবে চ্যালেঞ্জ করেছে যার ফলে একটা নতুন আলোচনার সূচনা ঘটেছে এবং তা নারীদের মর্যাদাকে একটি নতুন স্থানে নিয়ে গেছে।[৪] এই নারীরা ইতিহাস জুড়েই বিভিন্নভাবে আধিপত্যবাদী পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে, যা নারীমুক্তি অর্জনের জন্য সর্বাপেখা ভালো উপায় সম্পর্কে তাদের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক।[২]
মার্ক্সীয় নারীবাদ অনুসারে নারীর শোষিত হবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস্যটি হল নারীদের উৎপাদনশীল শ্রমবর্জিত হওয়া। তাই কয়েকজন মার্ক্সীয় নারীবাদী মজুরিভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে গৃহকর্মকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আন্দোলন করেছেন। শারলট পারকিনস গিলম্যানের (১৮৯৮) সহ আরও কিছু সমাজতান্ত্রিকের লেখায় ক্ষতিপূরণযোগ্য পুনরুৎপাদনশীল শ্রম তৈরির ধারণা উপস্থিত আছে। তারা বলেন, ব্যক্তিমালাধীন ক্ষেত্রে কাজ করার ফলে নারীর শোষণ শুরু হয়েছে।[৫] গিলম্যান বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানার ক্ষেত্রে এদের কাজের স্থানের ব্যবস্থা করলে, এদের কাজকে স্বীকৃতি দান করলে, এবং মূল্যায়িত করলে নারীর অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে।[২]
সম্ভবত, ক্ষতিপূরণযোগ্য পুনরুৎপাদনশীল শ্রমের সব থেকে উল্লেখযোগ্য প্রচারণা হচ্ছে আন্তর্জাতিক গৃহকর্মের বিনিময়ে শ্রম প্রচারণা। এটি ১৯৭২ সালে ইতালিতে ইন্টারন্যাশনাল ফেমিনিস্ট কালেক্টিভ কর্তৃক চালু হয়। সেলমা জেমস[৬], মারিয়ারোসা ডালা কস্টা[৭], ব্রিজেট গাল্টিয়ার এবং সিলভিয়া ফেডেরিচি[৮] এসময় একাডেমিক এবং পাবলিক ডোমেইনে প্রচুর পরিমাণে লেখা প্রকাশ করেন। যদিও এই প্রচারণা ইতালিতে একটি ছোট দল নিয়ে শুরু হয়েছিল, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই প্রচারণা সফল হয়। ফেডেরিচির সহায়তায় গৃহকর্মের বিনিময়ে মজুরির একটি শাখা নিউ ইয়র্ক এর ব্রুকলিনেও চালু হয়।[৮] হেইডি হার্টম্যান স্বীকার করেন (১৯৮১) এই আন্দোলনগুলো শেষপর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, কিন্তু তারপরও এটি গৃহকর্মের মূল্য এবং অর্থনীতির সাথে এর সম্পর্কের ব্যাপারে একটি মূল্যবান আলোচনা তৈরি করে।[৪]
মার্ক্সীয় নারীবাদীগণ আরেকটি সমাধানের প্রস্তাব করেন, যা নারীদের বাধ্যতামূলক ভাবে পুনরুৎপাদনশীল শ্রমের সাথে সম্পর্কিত। গতানুগতিক মার্ক্সীয় নারীবাদী আন্দোলন যেমন গৃহশ্রমের বিনিময়ে মজুরি প্রচারণা এর সমালোচনায় হেইডি হার্টম্যান বলেন, "এই প্রচেষ্টাগুলোতে নারীর সাথে পুরুষের সম্পর্কের দিকে না গিয়ে নারীর সাথে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে, যেখানে এটাই ধরে নেয়া হয় যে নারীর সাথে পুরুষের সম্পর্ককে নারীর সাথে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সম্পর্কের দ্বারাই ব্যাখ্যা করা যায়।"[৪] হার্টম্যান (১৯৮১) মনে করেন যে, গতানুগতিক আলোচনা নারী হিসেবে নারীর শোষণকে এড়িয়ে গেছে, আর তার চেয়ে বরং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সদস্য হিসেবে নারীর শোষণের দিকেই এটি মনোনিবেশ করেছে।
গেইলি রুবিন স্যাডোম্যাসিজম, বেশ্যাবৃত্তি, পর্নোগ্রাফি এবং নারী-সমকামী সাহিত্য, নৃতত্ত্ব এবং যৌন উপসংস্কৃতি এর উপর অনেক কিছু লিখেছেন। তিনি তার ১৯৭৫ সালের একটি রচনা দ্য ট্রাফিক ইন উইমেন: নোটস অন দ্য 'পলিটিকাল ইকোনমি' অফ সেক্স[৯] গ্রন্থে (যেখানে তিনি "লিঙ্গ ব্যবস্থা" নামক শব্দটি ব্যবহার করেন) মার্ক্সবাদের সমালোচনা করে বলেন, সেখানে পুঁজিবাদের অধীনে লিঙ্গবাদ অসম্পূর্ণ (অবশ্য তিনি এক্ষেত্রে মার্ক্সবাদের মৌলিক বিষয়গুলোকে নাকোচ করে দেন নি)।
আরও সম্প্রতি, অনেক মার্ক্সীয় নারীবাদীই তাদের মনোযোগ অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন যেখানে নারীরা উৎপাদনশীল শ্রমে অংশগ্রহণ করার পর আরও খারাপ অবস্থায় পতিত হয়েছে। ন্যান্সি ফলবর প্রস্তাব করেন যে, নারীবাদী আন্দোলনগুলো পুনরুৎপাদনশীল (ব্যক্তিমালিকানাধীন) জগৎ এবং উৎপাদনশীল কর্মক্ষেত্রের (রাষ্ট্রায়ত্ত) জগৎ উভয় ক্ষেত্রেই নারীর পুরুষের অধীনস্থ মর্যাদার বিষয়টিতে মনোনিবেশ করেছে।[১০] ২০১৩ সালের একটি সাক্ষাতকারে সিলভিয়া ফেডারিচি নারীবাদী আন্দোলনগুলোয় এটা বিবেচনায় আনতে বলেন যে, এখন অনেক নারীকেই উৎপাদনশীল এবং অনুৎপাদনশীল শ্রম দিতে বাধ্য করা হয়, যার ফল হয় তাদের "দ্বৈত বোঝা"।[১১] ফেডেরিচি বলেন, তবুও যতদিন পর্যন্ত নারীরা অপরিশোধিত শ্রমের বোঝা থেকে মুক্তি না পাবে, ততদিন পর্যন্ত নারীমুক্তি ঘটবে না। আর এজন্য তিনি প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের প্রস্তাব দেন, যেমন তিনি কর্মক্ষেত্রে শিশুযত্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে মজুরি ব্যবধান কমাবার প্রস্তাব করেন।[১১] সেলমা জেমস (২০১২) এর সাক্ষাতকারেও ফেডেরিচির এই প্রস্তাবগুলো উঠে আসে, এবং এই ব্যাপারগুলো সাম্প্রতিক রাষ্ট্রপতি নির্বাচনগুলোতেও নিয়ে আসা হয়।[৬]