আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক |
---|
সমাজবিজ্ঞানে, সমলৈঙ্গিক সামাজিকতা এর অর্থ হচ্ছে প্রেম অথবা যৌনচিন্তা না থাকা একপ্রকার সমলৈঙ্গিক সম্পর্ক। এ সম্পর্ক নিছক বন্ধুত্ব, পরামর্শদাতার সাথে সাধারণ সম্পর্ক অথবা অন্য কিছু হতে পারে। সমলৈঙ্গিক সামাজিকতার বিপরীত হচ্ছে বিষমলৈঙ্গিক সামাজিকতা, যেখানে যৌন সম্পর্ক ব্যতিরেকে বিপরীত লিঙ্গে সম্পর্ক তৈরী হয়। যদি দুইয়ের অধিক ব্যক্তি মিলে সম্পর্ক তৈরী হয়, তবে সেখানে সমলৈঙ্গিক সামাজিকতা (সমলিঙ্গে সম্পর্ক), বা উভলৈঙ্গিক সামাজিকতা (একইসাথে সমকামী ও বিষমকামীর সাথে সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা) অথবা বিষমলৈঙ্গিক সামাজিকতা (বিপরীত লিঙ্গের একাধিক ব্যক্তির মধ্যকার সম্পর্ক) তৈরী হতে পারে।
জিন লিপম্যান ব্লুম্যান প্রথমদিকে সমলৈঙ্গিক সামাজিকতা শব্দটির সংজ্ঞায় বলেন, এসমাজের সদস্যরা শুধুমাত্র তার সমলিঙ্গের মানুষের সাথে মেলামেশায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তবে এধরনের সদস্যদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক তৈরী হতেও পারে, নাও পারে।[১] ইভ সেডউইক তার পুরুষ সমলৈঙ্গিক অভিরুচি শীর্ষক আলোচনায় এই শব্দটিকে জনপ্রিয়করণ করেন।[২]
রোজ নামে একজন বিজ্ঞানী ১৯৮৫ সালে একটি গবেষণা করেন।[৩] ২০ থেকে ২৮ বছর বয়সী নারী এবং পুরুষের সমলিঙ্গে ও বিপরীত লিঙ্গে বন্ধুত্বের প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন তিনি। গবেষণা থেকে দেখা গিয়েছে, বিপরীত লিঙ্গে বন্ধুত্বের তুলনায় নারী এবং পুরুষ উভয়ই সমলিঙ্গে বন্ধুত্বকে নির্ভরশীল বলে ধরে নেন। সমলিঙ্গ এবং বিপরীত লিঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠার ধরনেও পার্থক্য খুজে পান এ গবেষক।
সংস্কৃতি, পরিবার এবং সামাজিক গঠন ভেদে সমলিঙ্গে অনুরক্তি ৩ থেকে ৯ বছরের বিকশিত হতে থাকে(লাফ্রেনিয়ার, স্ট্রেয়ার এবং গথিয়ার, ১৯৮৪; জ্যাকলিন এবং ম্যাকবয়, ১৯৭৮; হার্কনেস এবং সুপার, সিএম, ১৯৮৫)।[৪][৫][৬] ল্যাফ্রেনিয়ার, স্ট্রেয়ার এবং গোথার(১৯৮৪)[৬] ১ থেকে ৬ বছর বয়সী ৯৮ জন বালক এবং ৯৩ জন বালিকাকে ১৫ টি গ্রুপে বিভক্ত করে ৩ বছর ধরে গবেষণা করেন। তারা দেখতে পান বেশিরভাগ পশ্চিমা শিশুদের ৩-৪ বছর বয়সের মধ্যে নিজের যৌনতা ভিত্তিক আচরণে স্বতন্ত্রতা তৈরী হয়ে যায়। অর্থাৎ, অর্থাৎ নারী ও পুরুষ ভিত্তিক সুনির্দিষ্ট আচরণ পশ্চিমা শিশুরা প্রদর্শন করতে শুরু করে। যাইহোক, হার্কন্যাস এবং সুপার[৭] কেনীয় শিশুদের উপর করা আরেকটি গবেষণায় দেখতে পান, যে পর্যন্ত না শিশুদের বয়স ৬ থেকে ৯ বছর হচ্ছে, যৌনতা ভিত্তিক অনুরক্ততায় (সমলৈঙ্গিক সামাজিকতা) তাদের স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গী তৈরী হচ্ছে না। গবেষকরা গ্রামাঞ্চলের ১৫২ জন কেনীয় শিশুর উপর করা গবেষণায় দেখতে পান, পরিবার থেকে যৌনতা ভিত্তিক সুনির্দিষ্ট প্রথা বুঝানোর পরেই শিশুদের যৌনতা ভিত্তিক মানসিক পরিবর্তন তৈরী হয়। অর্থাৎ এরপর থেকে তাদের মধ্যে ছেলে হলে ছেলেদের প্রতি গাঢ় বন্ধুত্ব এবং মেয়ে হলে মেয়েদের প্রতি গাঢ় বন্ধুত্বের সুত্রপাত হয়।[৭]
এটা প্রতীয়মান হয় যে শিশুরা খুব ছোট বেলা থেকেই নিজেদের লিঙ্গের মানুষের প্রতি সামাজিক পক্ষপাতিত্ব দেখায়। বিশেষ করে গবেষণা থেকেও দেখা গিয়েছে, তিন অথবা চার বছর বয়সের শুরু থেকেই শিশুরা বিপরীত লিঙ্গের মানুষের চেয়ে তাদের সম লিঙ্গের মানুষের সাহচর্য বেশি পছন্দ করছে। (বুজেই এবং বান্দুরা, ১৯৯২)।[৮] অর্থাৎ অল্পবয়সী বালিকারা ছেলেদের (বালক এবং পুরু) তুলনায় মেয়েদের (বালিকা এবং নারী) প্রতি বেশি অনুরক্ততা প্রকাশ করে। একই চিত্র দেখা গিয়েছে অল্প বয়সী বালকদের ক্ষেত্রেও। ক্যারোল মার্টিন কৃত একটি গবেষণায় (১৯৮৯)[৯] দেখা গিয়েছে যে, সাড়ে চার বছরের বালকরা মেয়েদের তো অপছন্দ করেই এমনকি কোনো মেয়ে যদি "টমবয়ের" মত আচরণ করে, তবুও তারা "মেয়েলীসুলভ ছেলেদের" তুলনায় তাদের সাথে মিশতে অনীহা প্রকাশ করে। পক্ষান্তরে সাড়ে আট বছরের উর্ধ্বে যেসব ছেলের বয়স তারা মেয়েলীসুলভ ছেলেদের কম পছন্দ করে। বয়সের পার্থক্য ও আচরণের ভিন্নতাকে আমলে নিলে বুঝা যায় চার থেকে আট বছর বয়সের বাচ্চারা সমলৈঙ্গিক মানুষের সাথে মিলামেশাকে প্রাধান্য দেয় তা সমলৈঙ্গিক মানুষ যেরকম আচরণই করুক না কেন। অন্যদিকে আট বা তার উর্ধ্বে বয়স হলে, তখন সমাজ যেরকম আচরণ প্রত্যাশা করে, ছেলেরা তার সাথে তাল মিলিয়ে মেয়েলী ছেলেদের প্রতি অনীহা প্রকাশ করে। গবেষণায় আরো দেখা গিয়েছে যেসব শিশুর বয়স ১০ থেকে ১২ তারা সমলৈঙ্গিক মানুষের সাথে সামাজিকীকরণ করাকে বেশি পছন্দ করে। [১০]
সংজ্ঞানুসারে সমলৈঙ্গিক সামাজিকতা বলতে বিষমকামিতা বা সমকামিতা বুঝায় না। উদাহরণস্বরুপ, যেসব বিষমকামী পুরুষ; পুরুষের সাথে সামাজিকতা গড়ে তুলে তাদের সমলৈঙ্গিক সামাজিক বিষমকামী বলেও অভিহিত করা হয়। পুরুষদের মধ্যে পারস্পরিক আন্ত:সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নারীবাদীরাও এই শব্দটিকে ব্যবহার করেন। অড্রে লর্ড এপ্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেন "প্রকৃত নারীবাদীরা সর্বদা সমকামী নারীদের অধিকার নিয়ে সচেষ্ট থাকবে, এর জন্য তারা অন্য কোনো নারীর সাথে বিছানায় গমন করছে কিনা, তা বিবেচ্য নয়।"[১১]
ঐতিহাসিকভাবে সমলৈঙ্গিক সামাজিকতার চর্চা মুলত এমন পেশার মানুষদের মধ্যে দেখা যেত যা শুধুমাত্র পুরুষ অথবা শুধুমাত্র নারী নিয়ন্ত্রিত । যেমনঃ এক সময় নাবিকরা (ঐতিহাসিক মার্কাস রেডিকার জলদস্যুদের সমাজ ব্যাখ্যা করতে এই সমলৈঙ্গিক সামাজিকতা ব্যবহার করেছেন) শুধুমাত্র পুরুষ হত। ফলে অবধারিতভাবে তাদের মধ্যে গড়ে উঠত সমলৈঙ্গিক সামাজিকতা। সমলৈঙ্গিক সামাজিকতা মাত্রই যে সেখানে যৌন সম্পর্ক গড়ে উঠবে তা নয়, বরং এই সমাজ বলতে বুঝানো হয়, একই লিঙ্গের মানুষদের মধ্যে সহাবস্থান।
যেসব স্থানে আবশ্যিক ভাবে এই সমাজ গড়ে উঠেঃ
সাধারণত যে সমাজে যত বেশি লিঙ্গকে আশ্রয় করে নানারুপ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়, সে সমাজে তত বেশি সমলৈঙ্গিক সমাজ গড়ে উঠে।[১২]
সমকামিতা এবং সমলৈঙ্গিক সামাজিকতার মধ্যে যে সম্পর্ক তা নিয়ে রয়েছে চলমান বিতর্ক, বিজ্ঞানীরা সমকামিতা এবং সমলৈঙ্গিক সামাজিকতার মধ্যে কোন প্রকার যোগাযোগ আছে কিনা তা নিয়ে গবেষণা জারী রেখেছেন।[১৩] ইভ কসফস্কি সমকামিতা এবং সামলৈঙ্গিক সামাজিকতার মধ্যে একটি ধারাবাহিকতা আছে বলে মনে করেন। নারীবাদ ও নারী সমকামিতার মধ্যেও এই ধারাবাহিকতা আছে বলে মনে করা হয়; যা অড্রেইন রিচের "লেসবিয়ান কনটিনাম" (নারী সমকামিতার ধারাবাহিকতা) ধারণার সাথে সংগতিপূর্ণ। [১৪]
একই সাথে সেডউইগ পুরুষ সমলৈঙ্গিক সামাজিকতাকে ত্রিভুজের গঠনের সাথে তুলনা করেছেন। এই ত্রিভুজ বন্ধনে দুইজন পুরুষের মধ্যে গভীর কিন্তু অযৌন সম্পর্ক তৈরী হয় এবং তাদের মধ্যে নারীকে নিয়ে আলাপের মাধ্যমে সেই বন্ধনের প্রগাঢ়তা প্রকাশ পায়।[১৫] সেডউইগের বিশ্লেষণ রেনে গিরার্ডের দাবীর সাথেও মিলে। [১৬][১৭]
অস্ট্রেলীয় রিসার্চ সেন্টার ইন সেক্সের গবেষণা থেকে দেখা গিয়েছে, বিষমকামিতা মুলক বিভিন্ন কার্যক্রম যেমন একটা ছেলের নারীর প্রতি প্রেমের উদ্রেক হলে অন্য বন্ধুর সাথে তা নিয়ে আলাপ করতে করতে সমলৈঙ্গিক সামাজিকতা বৃদ্ধি পায়।[১৮]
জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে 'ভ্রার্তৃত্বপ্রেম (bromance) শব্দটি ব্যাপকহারে ব্যবহৃত হয়, যার মাধ্যমে বুঝানো হয়, দুইজন পুরুষ কোনো যৌন সম্পর্কে না থেকেও তারা একে অপরের খুব কাছের। সাধারণত দুজন বিষমকামী সমলিঙ্গের ব্যক্তিদ্বয়ের ক্ষেত্রেই এই শব্দ ব্যবহৃত হয়। তবে মিডিয়াতে সমকামী-বিষমকামী দুজন পুরুষের ক্ষেত্রেও এই শব্দের ব্যবহার পরিলক্ষিত হচ্ছে। একে সমকামী-বিষমকামী ভ্রার্তৃত্বপ্রেম বলা হয়। নারীদের জন্য বোনপ্রেম (উইম্যান্স) শব্দটি ব্যবহার করা হয়।