অশ্বজিৎ (সংস্কৃত: अश्वजित) বা অস্সজি (পালি: अस्सजि) (জীবনকাল- আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী) বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে পাঁচজন তপস্বীদের মধ্যে একজন ছিলেন, যিনি সিদ্ধার্থ গৌতমের সঙ্গে কঠোর তপস্যায় লিপ্ত হন এবং বুদ্ধত্ব লাভের পর গৌতম বুদ্ধের নিকট প্রথম ধর্মজ্ঞান প্রাপ্ত হন।
অস্সজির পিতা সেই আটজন ব্রাহ্মণের একজন ছিলেন, যারা সিদ্ধার্থ গৌতমের ভবিষ্যদ্বাণী করেন।[১]:১২ তার পিতা তাকে পরবর্তী জীবনে সিদ্ধার্থ গৌতমকে অনুসরণ করতে নির্দেশ দেন। সিদ্ধার্থ তপস্যার মাধ্যমে সত্যানুসন্ধানের জন্য গৃহত্যাগ করে আলার কালাম ও উদ্দক রামপুত্ত প্রভৃতি যোগীদের নিকট শিক্ষালাভ সম্পন্ন করলে অস্সজি সহ কৌণ্ডিন্য, ভদ্দিয়, বপ্প এবং মহানাম নামক পাঁচজন তপস্বী তাকে অনুসরণ করেন ও উরুবিল্ব নামক স্থানে একসাথে ছয় বছর ধরে কঠোর তপস্যায় লিপ্ত হন। বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে এই পাঁচজন তপস্বী পঞ্চবগ্গীয় বা ভদ্রক পঞ্চবর্গীয় নামে পরিচিত। এই কঠোর তপস্যার ফলে অনশনক্লিষ্ট সিদ্ধার্থ গৌতম মরণাপন্ন হয়ে উপলব্ধি করেন যে, অনশনক্লিষ্ট দুর্বল দেহে শরীরকে অপরিসীম কষ্ট দিয়ে কঠোর তপস্যা করে বোধিলাভ সম্ভব নয়। ধর্মচক্রপ্রবর্তন সূত্রাণুসারে, অসংযত বিলাসবহুল জীবনযাপন এবং কঠোর তপস্যার মধ্যবর্তী একটি মধ্যম পথের সন্ধান করে বোধিলাভ সম্ভব বলে তিনি উপলব্ধি করেন।[২] তিনি তাই আবার খাদ্য গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন ও সুজাতা নাম্নী এক স্থানীয় গ্রাম্য কন্যার কাছ থেকে তিনি এক পাত্র পরমান্ন আহার করেন।[৩] সিদ্ধার্থকে খাদ্য গ্রহণ করতে দেখে অস্সজি সহ সকল ভদ্রক পঞ্চবর্গীয় তার ওপর বিরক্ত হয়ে তাকে ছেড়ে বারাণসীর নিকট ঋষিপতনের মৃগ উদ্যানে যাত্রা করে চলে যান।[৪][৫][৬][৭]
সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধত্ব লাভ করার পর ঋষিপতনের মৃগ উদ্যানে যাত্রা করে অস্সজি সহ তার বাকি চারজন সাধনসঙ্গীকে খুঁজে বের করে তাদেরকে তার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান প্রদান করার সিদ্ধান্ত নেন। যদিও প্রথমে এই পঞ্চবগ্গীয় তপস্বীরা গৌতম বুদ্ধের সিদ্ধিলাভের ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন, কিন্তু শীঘ্রই তার নবলব্ধ জ্ঞান তাদের মুগ্ধ করে। গৌতম বুদ্ধ তাদের ধম্মচক্কপ্পবত্তন সুত্ত সম্বন্ধে শিক্ষা প্রদান করেন। পাঁচ দিন পরে গৌতম বুদ্ধ তাদের অনাত্তলক্ষন সুত্ত সম্বন্ধে শিক্ষাদান করেন। বুদ্ধের নিকট শিক্ষালাভের ফলে অস্সজি অর্হত হিসেবে উন্নীত হন।[৮]
কিন্তু জ্ঞানার্জনের পরে, বুদ্ধ তাদের সারনাথে গিয়েছিলেন, যেখানে তারা বিভক্তির পরে যাত্রা করেছিলেন। বুদ্ধ চারটি নোবেল সত্য এবং ধম্মচাক্কাপবত্তন সূত্র প্রচার করেছিলেন এবং তারা সংঘের প্রথম পাঁচ ভিক্ষু হয়েছিলেন। আসাজিই সর্বশেষ শিক্ষাগুলি বুঝতে পেরেছিলেন, এবং বুদ্ধকে তাকে এবং মহানামকে আরও ব্যাখ্যা দিতে হয়েছিল যখন অন্য তিনজন ভিক্ষু ভিক্ষা করতে বেরিয়েছিলেন। অর্হত্বলাভ প্রথম পর্যায়ে সোতপান্নায় পৌঁছানো তিনিই শেষ। অনাত্তলক্ষ্ণ সূত্রের প্রচারে তিনি অন্যদের সাথে অরহন্ত হয়েছিলেন।
রাজগৃহে ভিক্ষা করার সময় অস্সজিকে সারিপুত্ত লক্ষ্য করেন, এবং তার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে তাকে অনুসরণ করেন। অস্সজির ভিক্ষাগ্রহণ শেষ হলে, সারিপুত্ত তাকে তার শিক্ষক ও অণুসৃত শিক্ষার ব্যাপারে প্রশ্ন করেন। তিনি অনভিজ্ঞ বলে ব্যাখ্যা করে অস্সজি তার উত্তর দিতে প্রথমে অপারগ হলেও সারিপুত্তের অনমনীয়তায় তিনি দুইটি মাত্র শ্লোকে[n ১] গৌতম বুদ্ধের সমস্ত শিক্ষার নির্যাস ব্যক্ত করেন।[৫] শ্লোক দুইটির অর্থ অণুধাবন করে সারিপুত্ত প্রকৃত জ্ঞান লাভের উপায় খুঁজে পেয়েছেন, এই মর্মে তার বাল্যবন্ধু মোগ্গলনকে সংবাদ প্রেরণ করেন। পরে দুই বন্ধু সংঘে যোগদান করে গৌতম বুদ্ধের অন্যতম প্রধান দুই শিষ্যে পরিণত হন।[৯]
বৈশালী নগরে ভিক্ষা করার সময়, জৈন ধর্মাবলম্বী তার্কিক সচ্চক গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা সম্বন্ধে অস্সজিকে প্রশ্ন করেন। অস্সজি সংক্ষেপে অনাত্তলক্ষন সুত্ত সম্বন্ধে তার নিকট বক্তব্য রাখেন। অস্সজির নিকট গৌতম বুদ্ধের দর্শন সম্বন্ধে জেনে সচ্চক এই দর্শনকে নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যে পরবর্তীকালে লিচ্ছবি মহাজনপদে গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হন।[৫]