দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূলভূখণ্ড বা বহুল প্রচলিত নাম হিসাবে যাকে ইন্দোচীন বলা হয়, হলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি অঞ্চল। ইন্দোচীন একটি ভৌগোলিক শব্দ যা ঊনবিংশ শতাব্দীতে জনপ্রিয় ছিল। এই মহাদেশীয় অঞ্চলটি বর্তমানে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া হিসাবে অধিক পরিচিত। এই অঞ্চলগুলিতে ভারত ও চীন সভ্যতার প্রভাব আছে। এই অঞ্চল ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়া দেশ নিয়ে গঠিত। এই দেশ ধান চাষের জন্য বিখ্যাত ছিল। এই দেশকে সুবর্ণভুমি নামেও ডাকা হত। এই দেশগুলির সাথে ভারতীয় রাজ্যগুলির বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। পঞ্চতন্ত্র ও জাতকের গল্পে এই বাণিজ্য যাত্রার কথা জানা যায়।
ইন্দো-চীন নামের উত্পত্তিটি সাধারণত ডেনিশ-ফরাসী ভূগোলবিদ কনরাড মাল্টে-ব্রুনকে যৌথভাবে দায়ী করা হয়, যিনি ১৮০৪ সালে এই অঞ্চলটিকে ইন্দো-চীন হিসাবে অভিহিত করেছিলেন এবং স্কটিশ ভাষাবিদ জন লেইডেন, যিনি ইন্দো-চীনা শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। ১৮০৮ সালে এই অঞ্চলের বাসিন্দা এবং তাদের ভাষা বর্ণনা করতে।[১] এই অঞ্চলে চীন এবং ভারতের ঐতিহাসিক প্রভাব সম্পর্কে বিদ্বানদের মতামত পরস্পরবিরোধী ছিল এবং এই শব্দটি নিজেই বিতর্কিত ছিল — পরে মাল্টে-ব্রুন তাঁর ইউনিভার্সাল জিওগ্রাফির পরবর্তী সংস্করণে এর ব্যবহারের বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়েছিলেন যে, এটি চীনা প্রভাবকে বেশি জোর দিয়েছে, এবং এর পরিবর্তে চীন-ভারতকে পরামর্শ দিয়েছিল।[২] তবুও, ইন্দো-চীন ইতিমধ্যে কৃপণতা অর্জন করেছিল এবং শীঘ্রই গঙ্গার ওপারে আরও ভারত এবং উপদ্বীপের মতো বিকল্প পদগুলিকে সরবরাহ করেছিল। পরে, ফরাসিরা ফ্রেঞ্চ ইন্দোচিনার উপনিবেশ স্থাপন করার সাথে সাথে এই শব্দটির ব্যবহার ফরাসি উপনিবেশে আরও সীমাবদ্ধ হয়ে যায়,[৩] এবং আজ অঞ্চলটি সাধারণত মেইনল্যান্ড দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া হিসাবে পরিচিত।[৪]
এই অঞ্চলের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। এই দেশগুলি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন হিন্দু ও বৌদ্ধ রাজ বংশের দ্বারা শাসিত হয়েছে।[৫][৬][৭][৮][৯][১০]
ফরাসি উপনিবেশবাদীরা এই দেশগুলি দখল করে ইন্দোচীন নাম দেয়। এশিয়ায় ফরাসি শাসনের মুল ভিত্তি ছিল এই অঞ্চল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান এই অঞ্চল দখল করে। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এই অঞ্চল থেকেই আজাদ হিন্দ ফৌজ এর যাত্রা শুরু করেন।
স্নায়ুযুদ্ধ এই অঞ্চল সামিল হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ভিয়েতনামের নেতা হো চি মিন ফরাসি শাসনের বিরোধিতা করেন। দিয়েন বিয়েন ফু এর যুদ্ধ ফরাসি শাসনের উপর ছিল বড় আঘাত। কিন্তু ভিয়েতনাম বিভক্ত হয় উত্তর ও দক্ষিণ দুই ভাগে। বামপন্থীরা উত্তর ও ডানপন্থীরা দক্ষিণকে মদত দেন। যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে জড়িয়ে ৫৮০০০ সৈনিক সহ বিপুল ক্ষতির শিকার হয়। ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র সন্ধি করে। ২ জুলাই, ১৯৭৬ সালে দুই ভিয়েতনাম মিলিত হয়।
লাওসও অশান্তির হাত থেকে রেহাই পায়নি।
অন্যদিকে কম্বোডিয়ায় চলছিল উগ্রবাম পল পট কর্তৃক খমের রুজ অপশাসন। ভিয়েতনামের হাতে এর পতন হয় ১৯৭৯ সালে । এরপর চীন ভিয়েতনাম হামলা করে।
এই অঞ্চলের ভূগোল মালভুমি ও সমভুমিময়। এর উত্তরে চীন, পুর্বে দক্ষিণ চীন সাগর, দক্ষিণদিকে থাই উপসাগর, পশ্চিমে থাইল্যান্ড।
এই অঞ্চলের মালভুমি এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন ঢাল অঞ্চল। এই অঞ্চলে আন্নাম পর্বত আছে।
এই অঞ্চলের মুল নদনদী হল মেকং, টোনলে চাব, সং কো ইত্যাদি।
উত্তর ভিয়েতনামের রাজধানী ছিল এই শহর। এখন ভিয়েতনামের রাজধানী।
এই শহরের আদি নাম ছিল সাইগন। এই শহর দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী ছিল। এই শহরেই নেতাজীর শেষ ছবি তোলা হয়েছিল।
এই শহর কম্বোডিয়ার রাজধানী।
এই শহর লাওস দেশের রাজধানী।
এই অঞ্চলের জীবজগত সমৃদ্ধ। ধানচাষের সুবর্ণভূমি ছিল এই এলাকা। ইন্দোচীন বাঘ এখানেই পাওয়া যায়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূলভূখণ্ডের ভাষাসমূহ বিভিন্ন পৃথক ভাষা পরিবারের অংশ হলেও তাদের মধ্যে বহু মিল বর্তমান।[১১] এই ভাষাগুলি চীনা-তিব্বতি, মং-মিয়েন, তাই-কাদাই, অস্ট্রোনেশীয় ও অস্ট্রো-এশীয় পরিবারের অংশ, যা থাইল্যান্ড থেকে চীন পর্যন্ত বিস্তৃত।[১২]
হিলারিও দে সৌসা (২০১৫) দেখিয়েছেন যে দক্ষিণ চীনের ক্যান্টনীয় ও ফিংহুয়া উপভাষাও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূলভূখণ্ডের ভাষা অঞ্চলের অংশ।[১৩]
মার্ক পোস্ট (২০১৫) লক্ষ্য করলেন যে উত্তর-পূর্ব ভারতের অরুণাচল প্রদেশের তানি ভাষাসমূহ ভাষাতাত্ত্বিক শ্রেণিকরণের দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূলভূখণ্ডের ভাষা অঞ্চলের অংশ[১৪] এবং তিব্বতি প্রভাব ক্ষেত্রের ভাষার তুলনায় তানি ভাষাগুলিতে ক্রিওলের মতো রূপমূলতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বর্তমান।[১৫] মার্ক পোস্ট এটাও বলেছেন যে তানি সংস্কৃতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূলভূখণ্ডের পাহাড়ি সংস্কৃতির মতো এবং এটি শীতল পার্বত্য পরিবেশে অভিযোজিত হয়নি।[১৪]