এই নিবন্ধটি আরও সহজগম্য করতে, বিষয় অনুসারে অনুচ্ছেদে ভাগ করা উচিত। (মার্চ ২০১৯) |
বিপশ্যনা (সংস্কৃত) বা বিপস্সনা (পালী) ভারতের একটি অতিপ্রাচীন ধ্যান পদ্ধতি। এই বিদ্যাটি প্রায় [১] আড়াই হাজার বছর আগে গৌতম বুদ্ধ পুনরায় আবিষ্কার করেন। সংস্কৃতে বিপশ্যনা মানে কোনোকিছুকে 'বিশেষ ভাবে দেখা', এক্ষেত্রে 'বিশেষ' মানে, কোনোকিছুকে [১]'যথাযথ', 'যথাভূত' অর্থাৎ যেমনটা আছে ঠিক সেরূপেই, কোন প্রতিক্রিয়া না করে দ্রষ্টাভাব সহকারে দেখা। বিপশ্যনা স্বপর্যবেক্ষণ করে আত্মশোধন করার প্রক্রিয়া। নিজের স্বাভাবিক নিশ্বাসের চলাচলকে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতে করতে নিজের মনকে একাগ্র করে এই পদ্ধতির প্রথম ধাপ, আনাপানের, সূচনা হয়। নিজের শরীর ও মনের বিনশ্বর এবং অনিত্য প্রকৃতির প্রতি সংবেদনার স্তরে সজাগতাকে শাণ দিতে দিতে অনিত্যতা, দুঃখ এবং অহং-অস্মিতা মিলিয়ে যাবার চিরন্তন সত্যগুলি অনুভব করার নামই বিপশ্যনা। সরাসরি অনুভূতি দিয়ে এই সত্য-উপলব্ধি করাই শোধন-প্রণালী। [১] এই নিরঞ্জন ধর্মের পন্থা যদিও বুদ্ধ পুনরায় আবিষ্কার করে প্রচার করেছেন, তবে এই সাধনাটি কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ে অথবা দল-উপদলে আবদ্ধ নয়, বরঞ্চ জাতি-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সার্বজনীন দুঃখগুলির সার্বজনীন প্রতিকার হোল বিপশ্যনা। ফলে এটাকে যে কেউ, যেকোনো সময়ে, যেকোনো স্থানে, নিজের জাতিবর্ণ অথবা সম্প্রদায়ের সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্ব না রেখে অবাধে অনুশীলন করতে পারে এবং এর ফলাফল সমানই হবে।[২]
বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের থেরবাদ পরম্পরায় এই সাধনার প্রচার প্রায় দশম শতাব্দীর কাছাকাছি উঠে যায় কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে মায়ানমারের তোউঙ্গু এবং কোনবাউং রাজবংশ তখনকার সতিপট্ঠান সুত্ত, বিসুদ্ধিমগ্গ প্রভৃতি বিভিন্ন গ্রন্থ অবলম্বন করে আবার এই সাধনার প্রবর্তন করান। বিপশ্যনা হোল 'প্রজ্ঞা' মানে 'প্রকৃত সত্যের অন্তর্দৃষ্টি' কিংবা এককথায় 'প্রত্যক্ষ-জ্ঞান', যার সংজ্ঞা 'দুক্খ' বা দুঃখ, 'অনাত্ত' বা অনাত্ম ভাব এবং 'অনিচ্চ' বা অনিত্যতা, এগুলিই থেরবাদ বৌদ্ধদর্শনে, অস্তিত্বের তিনটে চিহ্ন।[৩][৪] মহাযান বৌদ্ধদর্শনে বিপশ্যনাকে 'শুন্যতা' এবং বুদ্ধ-প্রকৃতির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
পরে বিংশ শতাব্দীতে বিপশ্যনা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে এই পদ্ধতিটা কেন্দ্রীয় গুরুত্বের বিষয় হয়ে দাঁড়াল।[৫] ভারতীয় মূলের ব্রহ্মদেশজাত আচার্য সত্যনারায়ণ গোয়েঙ্কা তাঁর গুরু সায়াজি উ বা খিন-এর সান্নিধ্যে এই বিদ্যা শিখে লাভান্বিত হন এবং নিজের ক্ষমতা ও সদিচ্ছায় মানবসমাজকে দুঃখ হতে নিস্তার পাবার পথ দেখাবার উদ্দেশ্যে বিপশ্যনা বিশ্বের কাছে পৌঁছে দেন[৬]। তাঁর অন্যতম শিক্ষা, বিপশ্যনার মধ্যে লুকিয়ে আছে জীবনযাপনের কলা, বাঁচার কৌশল[৭]। সত্যনারায়ণ গোয়েঙ্কার উদ্যোগেই বিপশ্যনা আর কেবল বৌদ্ধদের মধ্যে আবদ্ধ নয়, তিনি বিপশ্যনার অসাম্প্রদায়িক এবং সার্বজনীন প্রকৃতিকে জনসমক্ষে তুলে ধরলেন এবং [৮]'ধর্ম' কথাটার যে বিস্মৃত প্রাচীন অর্থ ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল, যার কোনো নির্দিষ্ট জাতি এবং সম্প্রদায়ের, সংগঠিত রিলিজিয়ান-এর সঙ্গে বিন্দুবিসর্গ কোনো সম্পর্ক নেই, তা মনে করালেন। ধর্ম একটাই,[৯] আগুনের যেমন একটাই ধর্ম, পোড়ানো, জলের যেমন একটাই ধর্ম, প্রবাহিত হওয়া। ঠিক তেমনই মানুষের একটাই ধর্ম যেটা অনুভূতির স্তরে বোঝাতে এই বিপশ্যনা ধ্যান পদ্ধতি উদ্ভাবন হয়েছে।[১০] অবশ্য বিপশ্যনার উদ্দেশ্য শুধু মনকে একাগ্র করা অথবা রোগ সারানো নয়, এগুলো সাধনার পথে বিভিন্ন ধাপ। এর মূল উদ্দেশ্য মনের সমস্ত জাগতিক দুঃখ হতে নিস্তার পাওয়া, চিত্ত সমত্বে স্থাপন করা এবং মনের বিশুদ্ধি, যার চূড়ান্ত ফল পরমসুখ ও পূর্ণমুক্তি, বোধি। বিপশ্যনা, দুঃখের শিকড়ে থাকা তিনটে হেতু - আসক্তি, বিদ্বেষ এবং অবিদ্যা (ঔদাসিন্য), এগুলিকে খুঁড়ে খুঁড়ে উৎপাটিত করতে থাকে; অনুভূতির স্তরে গুটি গুটি পায়ে একজন বিপশ্যী যখন সমত্বের দিকে এগোতে থাকে, প্রিয়-অপ্রিয় ঘটনার মুখোমুখি হলে ঝোঁকের মাথায় প্রতিক্রিয়া করার তার স্বভাব পালটাতে থাকে, দুঃখের বাঁধনগুলো খুলতে থাকে। বিপশ্যনায় সফলতার মাপকাঠি একটাই, অনুশীলনে সমত্ব বজায় থাকা, কেবলমাত্র বই পড়ে অথবা বক্তৃতা শুনে বুদ্ধি বিলাস করে এপথে এগোনো সম্ভব নয়। তাই সত্যনারায়ণ গোয়েঙ্কা সর্বদা পরিশ্রম করে, পুরুষার্থ করে অনুশীলন করায় জোর দিয়েছেন।