বৌদ্ধধর্ম |
---|
এর ধারাবাহিক নিবন্ধের অংশ |
ত্রিপিটক |
---|
বৌদ্ধ ধ্যান মূলত বৌদ্ধধর্মে ধ্যান চর্চাকে বোঝানো হয়। বৌদ্ধ ধর্ম তত্ত্বে এর উল্লেখ ভাবনা (মানসিক উন্নয়ন) এবং ধ্যান (মানসিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আলোকিত চিত্ত) বলে রয়েছে।[১]
বৌদ্ধ ধর্মে মুক্তির পথ, নির্বাণ অর্জনের জন্য এর প্রয়োজন অপরিহার্য। অশুভ ভাবনা,[note ১] প্রতিত্যসমুত্পাদ,[note ২] স্মৃতি ও অনুস্মৃতি,[note ৩] আনাপানস্মৃতি,[note ৪] ব্রহ্মাবিহার [note ৫]সহ ধ্যানের বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরন করে নির্বাণ লাভ করা যায়। ধ্যানের এই পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করে স্মৃতি, সমাধি, শমথ এবং বিপাসনার উন্নয়ন সাধন করা যায়। এই পদ্ধতি সমূহের নিয়মিত অনুশীলন চিত্ত বা মন প্রশান্ত হয়।[১]
সব ধরনের বৌদ্ধ ধর্ম সঙ্ঘে ধ্যানের এই প্রকারের অনুশীলনের প্রচলন থাকলেও কিছু কিছু তফাৎ রয়েছে। থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্মে শমথ ও বিপাসনার প্রচলন দেখা যায়। চৈনিক ও জাপানি বৌদ্ধ ধর্মে সর্বস্তিবাদ এর চল বেশি দেখা যায়। আবার, তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মে দেবতা-যোগ এর প্রচলন দেখা যায়, যা শূন্যতা উপলব্ধি বা নির্বাণ লাভের জন্য ব্যবহার করা হয়।[২]
ধ্যান বা মেডিটেশনের কাছাকাছি বৌদ্ধ ধর্মে যা রয়েছে তা হলো ভাবনা বা ধ্যানা।[৩] আবার, তিব্বতি, চৈনিক ও জাপানি ভাষায় একে ঝ্যান বা ঝ্যাং বা জেন ও বলা হয়ে থাকে।[৪]
প্রাথমিক পর্যায়ে, একজন অনভিজ্ঞ ধ্যানীর জন্য ধ্যানের প্রস্তুতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। অভিজ্ঞ ধ্যানী, যেকোন অবস্থায়, যেকোন পরিস্থিতিতে, যেকোন ভাবে ধ্যান করতে সক্ষম। তবে অনভিজ্ঞ ধ্যানীর বেলায় ধ্যানীর মনোযোগ সহজেই বিচ্যুত হয় যার জন্য তাকে বেশ কিছু ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হয় যাতে করে ধ্যান করার সময় মনোনিবেশে কোন অসুবিধা না ঘটে।
ধ্যান শুরু করার পূর্বে সাধককে কিছু ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হয় যা অনেকে শীল বলেও জেনে থাকেন। [৫] অন্তত ৫টি বিষয়ে সাধককে ব্রত থাকতে হয়,[note ৬] যা পঞ্চশীল নামে পরিচিত।[৫]
ধ্যান মূলত যেকোন জায়গায়, যেকোন ভাবে, যেকোন অবস্থায় (যেমন বিদর্শন ধ্যান) করা সম্ভব।[৬] তবে বিশেষ কিছু জায়গা ধ্যানের ব্যাঘাত বা অনুকূল পরিবেশরূপে কাজ করে। অনুকূল পরিবেশ হল-
সাধারণত ১৮ রকমের জায়গা ধ্যানের অন্তরায় বলে গণ্য হয়।[৫] যেগুলো হলে- ১) জনবহুল আবাস, ২) নতুন ঘর, ৩) পুরানো-জীর্ণ ঘর, ৪) পথের পাশে, ৫) পানীয় জলাশয়ের পাশে, ৬) ক্ষেতের মাঝখানে, ৭) ফুল বাগানের মাঝখানে, ৮) ফল বাগানের মাঝখানে, ৯) শহরের মাঝখানে, ১০) কাঠের ঘর, ১১) ক্ষেতের পাশে, ১২) স্টেশন বা খেয়া ঘাটের পাশে, ১৩) পরিত্যাক্ত বাসা, ১৪) প্রত্যন্ত অঞ্চল, ১৫) সীমান্তবর্তী এলাকা, ১৬) পাপাচারে লিপ্ত এমন কারো সান্নিধ্য, ১৭) অমনুষ্য পরিবৃত আবাস, এবং ১৮) কল্যাণ মিত্রবিহীন আবাস।[৫]
সাধকের বা ধ্যানীর জন্য অনুকূল, এমন কোন আসন তথা বসার ভঙ্গি নির্বাচন করা প্রয়োজন। ধ্যানী চাইলে বসবার জন্য মেঝেতে বা ঐ স্থানে অনধিক চার আঙ্গুল পুরু তোষক ব্যবহার করতে পারে।[৫] দুই পা পরস্পর বিপরীতমুখী ভাজ করে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসাটাই অনুকূল।[৫] সেক্ষেত্রে পদ্মাসন , ভদ্রাসন , সুখাসন ও উতকুটিক আসন উত্তম হিসেবে গণ্য হয়।[৫]
ধ্যানে বসার আগে কিছু কাজ ধ্যানের ব্যাঘাত ঘটায়, যা হল[৭]-
শমথ ধ্যানের ক্ষেত্রে, সাধক বা ধ্যানীকে আচার্য বা শিক্ষকের নির্দেশ মত একটি ধ্যান নির্বাচন করে দিয়ে থাকেন। আচার্য, ধ্যানীর চারিত্রিক বিশিষ্ট অনুযায়ী বষয়বস্তু নির্ধারন করে দিয়ে থাকেন।[৭] যেমন-
পঞ্চনিবারণ বা ৫ ধরনের বিষয় ধ্যানে বাঁধা বা প্রতিবন্ধক রূপে কাজ করে। সেগুলো হলে
১) কামছন্দ: পঞ্চকামগুন বা রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস ও স্পর্শ-এর প্রতি যে আসক্তি তাই কামছন্দ। এটি ধ্যানের একাগ্রতাকে বাঁধা দেয়। ধ্যানে একাগ্রতা আনয়নের মাধ্যমে এর প্রতিহত করা যায়।[৫]
২) ব্যাপদ: ক্রোধ, ইর্ষা, হিংসা ও ঘৃণার বশবর্তী হয়ে অন্যের ক্ষতি করা বা করার ইচ্ছাই ব্যাপদ। সৎ কর্মতে অনীহা ব্যাপদের লক্ষণ।[৫]
৩) স্থিনমিদ্ধ: চিত্তের অলসতা, সংকোচতা, অস্পষ্টতা, অকর্মণ্যতা, অনুৎসাহ, অবসাদ ইত্যাদিকে স্থিনমিদ্ধ বলে। কুশল চিত্ত গ্রহণ করতে এটি অক্ষম ও অপারগ। মনে জোরকে দুর্বল বা নষ্ট করেই এর কাজ।[৫]
৪) ঔদ্ধত্য কৌকৃত্য: অস্থির চিত্তকেই ঔদ্ধত্য বলা হয়। ধ্যনের একাগ্রতা তথা অবলম্বন থেকে এটি বিচ্যুতি ঘটায়। এটা মনে অশান্তি আনে। আর, কৌকৃত্য হল মনের অনুশোচনা, আক্ষেপ, অনুতাপ ও উৎকণ্ঠাকে বোঝাঁ হয়। এর প্রতিপক্ষ হলে সুখ।[৫]
৫) বিচিকিচ্ছা: এর অপর নাম সন্দেহ। ধ্যানীর মনে যখন সন্দেহের জন্ম হয় তখন তাকে বিচিকিচ্ছার সৃষ্টি হয়, এবং এর ফলে ধ্যান বা কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত ণইতে পারে না। এর পরিণাম অনিশ্চয়তা। বিচার এর প্রতিপক্ষ।[৫]
মনকে শান্ত করার জন্য শমথ ধ্যানে ৪০ ধ্যেয় বা কর্মস্থান[note ১০] (যাকে অবলম্বন করে ধ্যান করা হয়) নির্বাচন করা হয়েছে। নিজের চরিত্র অনুযায়ী সাধক নিজে বা তার শিক্ষক এর বাছাই করেন।[৭] নিমিত্ত মূলত দেখা যায় এমন কোন বস্তু, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ আছে এমন রস, স্পর্শ করা যায় এমন ও মনে ভাবনা করা যায় এমন হয়ে থাকে। অর্থাৎ ৬ টি ইন্দ্রিয়ের যেকোনোটি দিয়ে অনুভব করা যায়।[৫] এই নিমিত্ত আবার ৩ রকমের হতে পারে।[৫]
ধ্যানী যখন উল্লিখিত ৪০ টি ধ্যেয়[note ১০] থেকে যে বিষয়টি তার ধ্যানের বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে, তখন সেটি বা সেই অবলম্বনটিই পরিকর্ম নিমিত্ত, যা ধ্যানের প্রাথমিক অবলম্বন।[৫]
ধ্যানী যখন ধ্যানের সেই পর্যায়ে পৌঁছে যান, যখন চোখ বন্ধ করলেও তিনি চোখ খোলা অবস্থায় পরিকর্ম নিমিত্ত যেমন দেখেন, ঠিক তেমনি দেখতে পান, তখন এই দর্শন শক্তিকে (মন দিয়ে যা দেখেন) উদগ্রহ নিমিত্ত বলা হয়ে থাকে। [৫]
উদগ্রহ নিমিত্ত চোখ বন্ধ অবস্থায় দেখতে সম্ভব হলেও তার মাঝে উজ্জ্বল-স্বচ্ছ ভাব থাকেনা।[৫] কিন্তু ধ্যানী, ধ্যানের গভীর স্তরে প্রবেশের মাধ্যমে, অবিচ্ছিন্নভাবে তাকে বিরামহীন ভাবে ধরে রাখতে পারলে, সেই নিমিত্তটি আরও স্পষ্ট হতে থাকে এবং একাগ্রতার সাথে ধ্যানের মাধ্যমে তা উজ্জ্বল হতে থাকে এবং আলোর মত জ্যোতির্ময় হয়ে ওঠে, তখন তাকে প্রতিভাগ নিমিত্ত বলা হয়।[৫] উল্লেখ্য, প্রতিভা নিমিত্ত শুধুমাত্র ১০ প্রকার কসিন, ১০ প্রকার অশুভ, কায়াগতানুস্মৃতি ও আনাপানা স্মৃতি ধ্যানেই লাভ হয়ে থাকে, বাকী ১৮ প্রকারে তা আসে না।[৫]
ধ্যান তপস্যার মাধ্যমে শমথ ধ্যানী লৌকিক জ্ঞানের ৩টি সমাধি লাভে সক্ষম হয়, যেগুলো হলে পরিকর্ম সমাধি, উপাচার সমাধি ও অপর্ণা সমাধি। [৫]
ধ্যানী যে নিমিত্ত নিয়ে ধ্যান শুরু করে, তা যতক্ষণ না পর্যন্ত মনে গেঁথে যাচ্ছে, ততক্ষণ মনেমনে, অর্থাৎ ঠোঁট বা জিহ্বা না নেড়ে মনস্থ করার চেষ্টা চালিয়া যাবেন।[৫] এই প্রচেষ্টার ধাপটিই পরিকর্ম সমাধি।[৫]
এই ধাপে ধ্যানী চোখের সামনে না থাকলেও সে নিমিত্ত দেখতে পান।[৫] উদগ্রহ নিমিত্তে তার আকার ও রঙ থাকে যা এখানে লোপ পায় এবং বজায় থাকে উপলব্ধিজাত একপ্রকার ধ্যান প্রতিকৃতি।[৫] নিয়মিত প্রতিভাগ নিমিত্তে মনোনিবেশ অব্যাহত রাখলে উপাচার্য সমাধি লাভ হয়। এর লাভ হলে, পঞ্ছনীবরণ প্রতিবন্ধকতা লোপ পায়।[৫]
এই স্তরে ধ্যানীর মনে সেই নিমিত্তটি প্রবলভাবে দৃঢ় হয় এবং স্থায়ীভাবে স্থিরতা লাভ করে।[৫] তখন ধ্যানীর কাছে লৌকিক নয় এমন কাজ করার ক্ষমতা অর্জিত হয়।[৫] সাধনার এই ধ্যান স্তরের নামই অপর্ণা সমাধি। এটিই মূলত ধ্যানের দৃঢ়তার শেষ ধাপ।[৫]
পঞ্চনীবরণ বাধাগুলো পেরিয়ে, ধ্যানের মাধ্যমে মন বা চিত্তকে উপাচার সমাধিতে নিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন কাজ বলে, ধ্যানী যখন উপাচার সমাধিতে পৌঁছে যান, তখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ধ্যানের নিমিত্ত বৃদ্ধি করে তাকে অপর্ণা সমাধিতে প্রতিষ্ঠিত করার আধ পর্যন্ত ধ্যান করে যাওয়া উচিত।[৭]
যেক্ষেত্র উপাচার সমাধি উৎপন্ন হওয়ার পরও তাকে ধরে রাখা যায় না, তখন ৭ (সাত) টি বিষয় রয়েছে, যার অনুকূল লাভ করে উপাচার থেকে অপর্ণা ধ্যানে উন্নীত হওয়া যায়।[৭]সেগুলো হল:
আবাস অনুকূলতা,[note ১১] গোচর অনুকূলতা,[note ১২] ভাষ্য অনুকূলতা[note ১৩] পূদগল অনুকূলতা,[note ১৪] ঋতু অনুকূলতা,[note ১৫] ইর্যাপথ অনুকূলতা,[note ১৬] এবং ভোজন অনুকূলতা।[note ১৭][৭]
সপ্ত অনুকূলতা লাভ করার পরেও ধ্যানী যদি অপর্ণা সমাধি লাভে সক্ষম না হলে তখন দশবিধ অপর্ণা কৌশল অবলম্বন করতে হয়, যা হল:
বস্তু বিশোধন,[note ১৮] ইন্দ্রিয় সমতা বিধান,[note ১৯] নিমিত্ত কুশলতা,[note ২০] চিত্ত প্রগ্রহ,[note ২১] সাত প্রকার ধর্ম বিচয়,[note ২২] এগার প্রকারে বীর্য উৎপন্ন করা,[note ২৩] এগার প্রকারে প্রীতি উৎপন্ন,[note ২৪] সময়ে চিত্তকে নিগ্রহ,[note ২৫] সাত প্রকার প্রশ্রদ্ধি উৎপন্ন,[note ২৬] এগার প্রকার সমাধি উৎপন্ন,[note ২৭], পাঁচ প্রকার উপেক্ষা উৎপন্ন,[note ২৮] সময়ে চিত্তকে সম্প্রহর্ষিত,[note ২৯] সময়ে চিত্তকে অধ্যুপেক্ষা করা,[note ৩০] অসমাধিস্থ ব্যক্তি বর্জন[note ৩১] সমাধিস্থ ব্যক্তির সেবা করা,[note ৩২] এবং তদধিমুক্ততা।[note ৩৩][৫]
ধ্যান অনুশীলনে ৬টি বিষয়: বিতর্ক, বিচার, প্রীত, সুখ, উপেক্ষা ও একাগ্রতা ধ্যানের অঙ্গ বলে পরিচিত।[৫]
ধ্যান বা ভাবনা করার সময় ধ্যানী বিভিন্ন স্তরে অবতীর্ণ হয়ে থাকেন যাকে ধ্যানের শ্রেণীও বলা হয়ে থাকে। এই স্তর বা শ্রেণী সমূহকে ১০ ভাগে বিভক্ত, যা প্রথম থেকে দশম ধ্যান পর্যন্ত বিস্তৃত।[৫]
বৌদ্ধ ধ্যান ২ ধরনের হয়ে থাকে, ১) বিদর্শন, ২) শমথ।
বৌদ্ধ ধর্মের মূল লক্ষ্য, নির্বাণ লাভের জন্য বিপশ্যনা বা বিপাসনা সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। এই পদ্ধতির ধ্যান অনেক পুরানো। কোন কিছুকে বিশেষভাবে দেখাকেই সংস্কৃতিতে বিপশ্যনা বলা হয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে যে বস্তু যেমন আছে, তাকে সেভাবে দেখার মধ্য দিয়ে আত্মসংশোধন করা যায়। মহাস্মৃতিপ্রস্থান সূত্রে বিদর্শন ধ্যানের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এখানে স্মৃতিপ্রস্থানকে চারটি মূল অংশে বিভক্ত করা হয়েছে।
শরীরের অবস্থা ও তার প্রতিটি ক্রিয়াকে বিশেষভাবে দর্শনই কায়ানুদর্শন। কায়ানুদর্শনে যে ব্যাপারগুলো নিয়ে ভাবনা বা ধ্যান করা হয়:
বৌদ্ধ ধর্মে যেকোন প্রকারের অনুভূতিকেই বেদনা বলা হয়ে থাকে। বেদনানুদর্শন হল সুখ, দুঃখ, উপেক্ষা এই ধরনের সকল অনুভূতিকে বিশেষভাবে দর্শন। বেদনানুদর্শনে যে ব্যাপারগুলো নিয়ে ভাবনা বা ধ্যান করা হয়:
মনের বিভিন্ন বৃত্তি যেমন লোভ, হিংসা সহ অন্যান্য যে সকল প্রবৃত্তির উদয় হয়, সেগুলোকে বিশেষভাবে দর্শনই চিত্তানুদর্শন। চিত্তানুদর্শনে যে ব্যাপারগুলো নিয়ে ভাবনা বা ধ্যান করা হয়:
ষড়ায়তন (দেখা, শোনা, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ ও ধর্ম) এর মাধ্যমে শরীর ও মনের অবস্থার পরিবর্তনকে বিশেষভাবে দর্শনই ধর্মানুদর্শন। ধর্মানুদর্শনে যে ব্যাপারগুলো নিয়ে ভাবনা বা ধ্যান করা হয়:
শমথ ধ্যান হল মনোযোগ বা সমাধির গঠন করা যা প্রশান্তির মাধ্যমে স্থাপিত হয়। এর মূল লক্ষ্য হলো মনকে শান্ত করা এবং একাগ্রতা স্থাপন করা। মতান্তরে এর মাধ্যমে অতি-প্রাকৃতিক ক্ষমতার অর্জন করা যায়। শমথ ধ্যানে চল্লিশ প্রকারের অনুশীলন রয়েছে।[৮]
শমথ ধ্যান হল মনোযোগ বা সমাধির গঠন করা যা প্রশান্তির মাধ্যমে স্থাপিত হয়।[৮] এর মূল লক্ষ্য হলো মনকে শান্ত করা এবং একাগ্রতা স্থাপন করা।[৮] মতান্তরে এর মাধ্যমে অতি-প্রাকৃতিক ক্ষমতার অর্জন করা যায়। শমথ ধ্যানে চল্লিশ প্রকারের অনুশীলন রয়েছে।[৮]
দশ প্রকারের বিষয় আছে যাকে নিমিত্ত করে ধ্যান করা হয়, যাদের একত্রে দশ কসিন বলা হয়ে থাকে।[৮]
১) পৃথিবী কসিন ধ্যান: পৃথিবী তথা মাটিকে বিষয় করে যখন ভাবনা করা হয় তখন তাকে পৃথিবী কসিন ধ্যান বলা হয়ে থাকে।পৃথিবী কসিন ধ্যান আবার ২ প্রকারের হয়ে থাকে, প্রস্তুতকৃত ও প্রকৃতিগত। চারপ্রকার দোষ (লাল, নীল, সাদা ও হলুদ রঙ) বিবর্জিত, গেরুয়া রঙের মাটি নিয়ে কসিন প্রস্তুত করা হয়। মাটি থেকে ঘাস-গুল্ম, পাথর ইত্যাদি পরিষ্কার করে পানিতে মিশিয়ে কাদায় পরিণত করে দেড় বিঘত বনাম দেড় বিঘত ন্যাকড়া নিয়ে তাতে চার আঙ্গুল পুরু মাটির বৃত্ত প্রস্তুত করে নিতে হয়। এটা শুকিয়ে গেলে, ঐ ন্যাকড়াটি যেকোন স্থানে নিয়ে যাওয়া যায়। প্রস্তুত শেষে, সেই নিমিত্ত এক জায়গায় রেখে, তার থেকে আড়াই হাত দূরে এবং ষোল আঙ্গুল উঁচু স্থানে বসে, মনোনিবেশ করে ধ্যান করতে হয়। এভাবে পঞ্চম ধ্যান পর্যন্ত উপনীত হওয়া যায়।[৮]
২) আপ কসিন ধ্যান: এই ধ্যানের নিমিত্ত হলও পুকুর, জলাশয়, হ্রদ, সমুদ্র বা পাত্রে পূর্ণ পানি। পানিতে কোন রঙ থাকা যাবে না, অর্থাৎ তাকে বর্ণহীন হতে হবে। এরপর তাকে নিমিত্ত করে ধ্যান করতে হয়। এভাবে পঞ্চম স্তর পর্যন্ত ধ্যান করা যায়।[৮]
৩) তেজ কসিন ধ্যান: এই ধ্যানের বিষয় হল আগুনের শিখা। আগুন জ্বালানোর পর তার সামনে মাদুর, মোটা কাপড, চাটাই ধরনের যেকোন কিছু চার আঙ্গুল সমান গোল করে ছিদ্র করে, তাতে মনোনিবেশ করে ধ্যান করতে হয়। এভাবে পঞ্চম স্তর পর্যন্ত ধ্যান করা যায়। [৮]
৪) বায়ু কসিন ধ্যান: এই ধ্যানে বাতাসকে অনুভব করে ধ্যান করতে হয়। বাতাসে দুলছে এমন কিছুতে মনোনিবেশ করে ধ্যান করা যায়। এভাবে পঞ্চম স্তর পর্যন্ত ধ্যান চালিয়ে যাওয়া যায়।[৮]
৫) নীল কসিন ধ্যান: এই ধ্যানের বিষয়বস্তু নীল রঙের ফুল বা কাপড়। নীল ফুলের বাঁট দেখা না যায়, এভাবে রেখে বা নীল রঙের মণ্ডল প্রস্তুত করে তাতে মনোনিবেশ করে ধ্যান করা যায়। এভাবে পঞ্চম স্তর পর্যন্ত ধ্যান চালিয়ে নেওয়া যায়।[৮]
৬) পীত কসিন ধ্যান: এই ধ্যানের বিষয়বস্তু হলুদ রঙের ফুল বা কাপড়। হলুদ ফুলের বাঁট দেখা না যায়, এভাবে রেখে বা হলুদ রঙের মণ্ডল প্রস্তুত করে তাতে মনোনিবেশ করে ধ্যান করা যায়। এভাবে পঞ্চম স্তর পর্যন্ত ধ্যান চালিয়ে নেওয়া যায়।[৮]
৭) লোহিত কসিন ধ্যান: এই ধ্যানের বিষয়বস্তু লাল রঙের ফুল বা কাপড়। লাল ফুলের বাঁট দেখা না যায়, এভাবে রেখে বা লাল রঙের মণ্ডল প্রস্তুত করে তাতে মনোনিবেশ করে ধ্যান করা যায়। এভাবে পঞ্চম স্তর পর্যন্ত ধ্যান চালিয়ে নেওয়া যায়।[৮]
৮) অবদাত কসিন ধ্যান: এই ধ্যানের বিষয়বস্তু সাদা রঙের ফুল বা কাপড়। সাদা ফুলের বাঁট দেখা না যায়, এভাবে রেখে বা সাদা রঙের মণ্ডল প্রস্তুত করে তাতে মনোনিবেশ করে ধ্যান করা যায়। এভাবে পঞ্চম স্তর পর্যন্ত ধ্যান চালিয়ে নেওয়া যায়।[৮]
৯) আলোক কসিন ধ্যান: এই ধ্যানের বিষয়বস্তু হল জানালা বা দেয়ালের ছিদ্র দিয়ে আসা আলোক রশ্মি। এতে মনোনিবেশ করে ধ্যান করতে হয়। এভাবে পঞ্চম স্তর পর্যন্ত ধ্যান চালিয়ে নেওয়া যায়।[৮]
১০) আকাশ কসিন ধ্যান: এই ধ্যানের বিষয় হল দৃশ্যমান আকাশ। জানালা বা দেয়ালের ছিদ্র নিয়ে দেখা যায় এমন পরিমাণ দৃশ্যকে কেন্দ্র করে ধ্যান করতে হয়। এভাবে পঞ্চম স্তর পর্যন্ত ধ্যান চালিয়ে নেওয়া যায়।[৮]
মৃত্যুর পর মানব দেহে পরিবর্তন ঘটে এবং এই পরিবর্তনকে নিমিত্ত করে ধ্যানকেই দশ অশুভ ধ্যান বলা হয়। প্রথমত বর্ণ, অর্থাৎ মৃতদেহটি কোন বর্ণের, কালো, সাদা, হলুদাভ ইত্যাদি সম্পর্কে ভাবনা। দ্বিতীয়টি হল মৃতদেহটি কোন লিঙ্গের এবং বয়সের সে বিষয়কে নিমিত্ত করে ভাবনা। তৃতীয়টি হলও সংস্থান, অর্থাৎ এটা মৃতদেহের মস্তক, গ্রীবা, হাত, পা, উদর ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত হয়ে ভাবনা। চতুর্থটি হল দিশা, অর্থাৎ দেহের ডান-বাম, উপর-নীচ ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত হয়ে ভাবনা। পঞ্চমটি হল অবকাশ, অর্থাৎ এখানে হাত আছে, পা আছে, মাথা আছে ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত হয়ে ভাবনা। ষষ্ঠ হল পরিচ্ছেদ, অর্থাৎ মাথা চুল দিয়ে আচ্ছন্ন, দেহ ত্বক দিয়ে আচ্ছন্ন ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে অবগত হয়ে ভাবনা। সপ্তম হল সন্ধি, অর্থাৎ দেহে আট হাজার সন্ধি (জয়েন্ট) আছে, যেমন আঙ্গুলের সন্ধি, হাতের সন্ধি ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত হয়ে ভাবনা। অষ্টম হল দেহস্থ বিবর বা ছিদ্র, যেমন কান, নাক ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত হয়ে ভাবনা। নবম হল নিম্ন, অর্থাৎ দেহে মুখ গহ্বর, গলনালী ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত হয়ে ভাবনা। দশম হল স্থল, অর্থাৎ দেহের যে জায়গাগুলো উঁচু হয়ে থাকে যেমন কপাল, নাক ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত হয়ে ভাবনা। পরিশেষে সমস্ত, অর্থাৎ সমস্ত মৃতদেহকে এক ভেবে ভাবনা করা।[৮]
অনুস্মৃতি বলতে এক মনে কোন কিছু বার বার স্মরণ করা। বৌদ্ধ ধর্মে ১০ প্রকার অনুস্মৃতির বিবরণ পাওয়া যায়:
১) বুদ্ধানুস্মৃতি: গৌতম বুদ্ধের নয় গুণকে স্মরণ করে ধ্যান করাই বুদ্ধানুস্মৃতি ধ্যান, যে গুণ গুলো হলঃ অরহত, সম্যক সম্বুদ্ধ, বিদ্যাচরণ সম্পন্ন, সুগত, লোকবিদ, অতুলনীয় ও শ্রেষ্ঠ সারথি, দেব-মানুষের শিক্ষক/শাস্তা, জ্ঞানী, এবং ভগবান।[৮]
২) ধর্মানুস্মৃতি: ধর্মের ছয় গুণকে স্মরণ করে ধ্যান করাই ধর্ম্নুস্মৃতি ধ্যান, যে গুণ গুলো হলঃ ধর্ম সুব্যাখ্যাত, স্বয়ং দৃষ্ট, কালাকাল হীন, "এসো ও দেখো" বলার যোগ্য, নির্বাণগামী ও বিজ্ঞব্যক্তি দ্বারা প্রত্যবেক্ষণযোগ্য।[৮]
৩) সঙ্ঘানুস্মৃতি: সঙ্ঘকে স্মরণ করে ধ্যান করাই সঙ্ঘানুস্মৃতি ধ্যান। সঙ্ঘের ৯ গুণ হলঃ সুপ্রতিপন্ন, ঋজুপ্রতিপন্ন, ন্যায়প্রতিপন্ন, আহবানযোগ্য, সতকারযোগ্য, দক্ষিণারযোগ্য, অঞ্জলিযোগ্য, অনুত্তর পূর্ণ ক্ষেত্র।[৮]
৪) শীলানুস্মৃতি: শীলের সদাচার অনুসরণ করে ধ্যানই হল শীলানুস্মৃতি। বৌদ্ধ ধর্মে পঞ্চশীল, অষ্টশীল সহ যেকোন শীলকে কেন্দ্র করেই এই ধ্যান করা যায়।[৮]
৫) ত্যাগানুস্মৃতি: ত্যাগ বা দানকে অনুসরণ করে ধ্যান বা ভাবনাকেই ত্যাগানুস্মৃতি বলা হয়।[৮]
৬) দেবতানুস্মৃতি: দেবতাদের গুণানুস্মরণে করা ধ্যান বা ভাবনাকেই দেবতানুস্মৃতি বলা হয়।[৮]
৭) উপশমানুস্মৃতি: নির্বাণের সুখ বা সকল দুঃখের উপশমকে চিন্তা করে যে ধ্যান করা হয় বা ভাবনা করা হয়, তাকেই উপশমানুস্মৃতি বলা হয়।[৮]
৮) মরণানুস্মৃতি: মরণ বা মৃত্যুকে উপশমকে চিন্তা করে যে ধ্যান করা হয় বা ভাবনা করা হয়, তাকেই মরণানুস্মৃতি বলা হয়।[৮]
৯) কায়াগতানুস্মৃতি: দেহের বত্রিশ প্রকারের অশুচি ( কেশ, লোম, নখ, দাঁত, ত্বক, মাংস, স্নায়ু, অস্থি, মজ্জা, মস্তিষ্ক, হৃদয়, ক্লোম, ফুসফুস, প্লিহা, যকৃৎ, অন্ত্র, বৃহদান্ত্র, বৃক্ক, বিষ্ঠা, অশ্রু,সিকনি, থুথু, শ্লেমা, পিত্ত, মূত্র, পুঁজ, স্বেদ, মেদ, লাসিক ইত্যাদি) কেন্দ্র করে যে ধ্যান করা হয় তাকেই কায়াগতানুস্মৃতি বলা হয়।[৮]
১০) আনাপানা স্মৃতি: শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর মনোনিবেশ করে যে ধ্যান করা হয়, তাকেই আনাপানা স্মৃতি বলা হয়।[৮]
চার অপ্রমেয় ধ্যান বা ব্রহ্মবিহার ধ্যান হল:
১) মৈত্রী ভাবনা: প্রেম, ভালবাসা, বন্ধুত্ব ইত্যাদিকে নিমিত্ত করে ভাবনা বা ধ্যান। এর প্রতিপক্ষ হল দ্বেষ, হিংসা ও ক্রোধ। [৫]
২) করুণা ভাবনা: অপরের ভাল এবং সুখ কামনাকে নিমিত্ত করে ভাবনা বা ধ্যান। এর প্রতিপক্ষ হল হিংসা।[৫]
৩) মুদিতা ভাবনা: অন্যের সুখ, সমৃদ্ধি, সম্পদ, সৌভাগ্য, লাভ-যশ, ঐশ্বর্য ইত্যাদি দেখে আনন্দিত হওয়াকে নিমিত্ত করে যে ভাবনা বা ধ্যান। [৫]
৪) উপেক্ষা ভাবনা: মনের মধ্যে নিরপেক্ষ, সাম্য ও মধ্যস্থতাকে ভিত্তি করে যে ভাবনা বা ধ্যান, তাকেই উপেক্ষা ভাবনা বলা হয়। [৫]
খাদ্য বা পানীয় বস্তু গ্রহণ করার পর, পরিশেষ তার পরিণতি মল, মূত্র, ঘাম বা অন্য দৈহিক বর্জ্য যা ঘৃণ্য, বস্তুতে পরিণত হয়।[৫] এই বিষয়কে কেন্দ্র করে ভাবনা করা বা ধ্যান করাকেই এক সংজ্ঞা ধ্যান বা আহার প্রতিকূল সংজ্ঞা ধ্যান বলা হয়।[৫]
মানুষের শরীরে কঠিন, তরল, উষ্ণ, বায়বীয়- এই চার ধাতু নিয়ে বিশেষণ করে যে ধ্যান বা ভাবনা করে হয়ে থাকে তাকে এক ব্যবস্থান ধ্যান বা চতুর্ধাতু ব্যাবস্থান ধ্যান বলা হয়।[৫]
সাধক রূপাবচর (পঞ্চম স্তর পর্যন্ত ধ্যান) ধ্যানে যথাযথ আয়ত্ত করতে পারলে উপলব্ধি করতে পারে যে সমস্ত দুঃখের কারণ হল এই ভৌতিক দেহ। তখন তার রূপের প্রতি বিরাগ উৎপন্ন হয় এবং অরূপ ধ্যানে মনোনিবেশ করে থাকে। এই চার অরূপ ধ্যান হল:
১) আকাশ অনন্ত আয়তন ধ্যান: ধ্যানী অসীম আকাশকে অবলম্বন করে ধ্যান করে থাকে।[৫]
২) বিজ্ঞান আয়তন ধ্যান: ধ্যানী অনন্ত বিজ্ঞান আয়তনকে অবলম্বন করে ধ্যান বা ভাবনা করতে থাকে।[৫]
৩) আকিঞ্চন আয়তন ধ্যান: আকাশ অনন্ত আয়তন ধ্যান ও বিজ্ঞান অনন্ত আয়তন ধ্যান করে ধ্যানী শূণ্যতা ও একাকীত্বতা উপলব্ধি করেন। আকিঞ্চন আয়তন ধ্যানে ধ্যানী শূন্যতা অনুভব করে থাকে।[৫]
৪) নৈব সংজ্ঞা বা না সংজ্ঞা আয়তন ধ্যান: এই ধ্যানের মধ্যে একেবারে সুক্ষাতিসূক্ষ্ম সংজ্ঞাগুলোই বিদ্যমান থাকে। ধ্যানের এই স্তর হল লোকায়ত স্তরের সর্বশেষ স্তর।ধ্যানী মনে মনে "শান্ত-শান্ত" বলে আবৃতি করতে থাকেন।[৫]
ধ্যান সম্পর্কে পালি নিকায় সমূহে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। যেমন, পটিসম্ভিদামাগ্গ-এর আনাপানা স্মৃতি সূত্রে কীভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসকে নিমিত্ত করে ধ্যান করা যায়, তার বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায়।
প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীর দিকে বুদ্ধঘোষের বিশুদ্ধিমাগ্গ-কে ধ্যানের নির্দেশিকা হিসেবে থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্মে গণ্য করা হয়। বুদ্ধঘোষ তাঁর বিশুদ্ধিমাগ্গ গ্রন্থে নতুন কিছু প্রবর্তন করেননি, বরং তিনি ত্রিপিটকের বিভিন্ন অংশ থেকে বিভিন্ন সূত্র ও টীকা বিশ্লেষণ করে এবং তৎকালীন চল অনুসারে যে সকল ধ্যান করা হত, তিনি সেগুলোর উল্লেখ ও ব্যাখ্যা করেন। চল্লিশ ধ্যেয় [note ১০] সম্পর্কে এই গ্রন্থে বিশদ আলোকপাত করে হয়েছে।
বৌদ্ধ ধর্মে শমথ হল, কোন কিছুকে ভিত্তি করে বা নিমিত্ত করে তাতে মনোনিবেশ করা। বর্মী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা শমথ ধ্যানকে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করেন। অন্য দিকে, থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা শমথ ও বিদর্শন ধ্যানকে একটি অপরটির সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত বলে মনে করেন।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বার্মায় (বর্তমানে মিয়ানমার) বিপাশনা ধ্যানের নবজাগরণ হয়। মিঙ্গুন সেয়াদো, উ নারাদা এবং মাহাসি সেয়াদো এর বিকাশ ঘটান। তাঁদের মতে, শমথ ধ্যান অপ্রয়োজনীয় নয়, বরং এটি বিপাশনার সহায়ক হিসেবে অনুশীলন করা যায়। তবে শমথ ধ্যান করে নির্বাণ লাভ সম্ভব নয়, এর জন্য বিদর্শন ধ্যান আবশ্যক। আরেক বর্মী ধারা আছে যা লেদি সেয়াদো, বা খিন এবং এস, এন, গোয়েঙ্কা মানুষের কাছে প্রচার করেন, যা প্রায় একই ধরনের ধ্যানের অনুশীলন। তাঁদের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল, প্রথম পক্ষ আনাপানা স্মৃতি ধ্যানের মনোনিবেশ পেট ফোলা ও কমার উপর জোর দেয়, অন্য দিকে দ্বিতীয় পক্ষ নাকে শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুভূতিতে মনোনিবেশ করে ধ্যানে জোর দেয়।
থাইল্যান্ডের, শ্যাম অরণ্য ধারাটি ভদন্ত আচান মান ভুরিদত্তো থেরো ধারা থেকে এসেছে, যা আচান ছ্যা মানুষের কাছে প্রচার করেন এবং তা জনপ্রিয় করে তোলেন। এই ধারা মতে, শমথ ও বিদর্শন, উভয়ই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
থাইল্যান্ডে আরও একটি চল রয়েছে, যেটি হল ভদন্ত লউংপু সদ কান্তসারো-র বিজ্জা ধম্মকায়া ধ্যান। এই ধারা অনুযায়ী ধর্ম ও দেহকে নিমিত্ত করে ধ্যান করা হয়, যা শ্বাস-প্রশ্বাসকে কেন্দ্র করে ও সাম্য অরহম মন্ত্র জপ করে নির্বাণ সাধনা করা হয়।
সর্বস্তিবাদ অনুযায়ী মানসিক ও জাগতিক, উভয়েরই অস্তিত্ব আছে। [৯] এই মতবাদ অনুযায়ী, কোন জাগতিক বস্তুর স্বতন্ত্র ও চিত্ত নিরপেক্ষ অস্তিত্ব থাকে।[৯] এই ধারা থেকে আবার দুইটি ধারার বিকাশ ঘটে, সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক। মূলত সৌত্রান্তিকবাদী গণ সূত্র পিটকের সূত্র সমূহকে প্রাধান্য দিয়ে তাঁদের মতবাদের বিকাশ ঘটিয়েছে, অন্য দিকে বৈভাষিক গণ অভিধর্ম পিটকের টীকা ও ব্যাখ্যা সমূহের ভিত্তিতে তাঁদের মতবাদের বিকাশ ঘটিয়েছে। এই ধারার ধ্যান তত্ত্ব অনুসারে পূর্ব এশিয়া ও তিব্বতে সাধনা করা হয়।। এই ধারার ধ্যানী গণ যোগাচার্য নামে পরিচিত। হিন্দু কুশ পর্বতমালার দক্ষিণাংশের ব্যাক্ট্রিয়া, কাশ্মীর ও গান্ধার অঞ্চলে এই ধারার বৌদ্ধ ভিক্ষু গণ তাঁদের মতবাদ অনুযায়ী ধ্যান সূত্র মতে যোগ আচারের বিকাশ ঘটায়।
কে, এল, ধাম্মাজ্যোতির মতে, সর্বস্তিবাদ ধ্যানীগণ মূলত শমথ ধ্যানে সাধনা করে থাকে। এই ধারায় চিত্ত বা মনের পঞ্চ স্থিরতার উপর কেন্দ্র করে ধ্যান করা হয়ে থাকে, যেগুলো হল[১০]:
১) রাগী চরিত্রের লোকদের জন্য অশুভ ধ্যান,
২) হিংসা চরিত্রের লোকদের জন্য চার ব্রহ্ম বিহার ধ্যান,
৩) লোভী চরিত্রের লোকদের জন্য আনাপানা স্মৃতি বা শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর মনোনিবেশ করে ধ্যান,
৪) শ্রদ্ধাশীল চরিত্রের লোকদের জন্য অনুস্মৃতি ধ্যান, এবং
৫) বিতর্ক বা সবসময় মনের মধ্যে দোটানায় ভোগে এমন চরিত্রের লোকদের জন্য আনাপানা স্মৃতি বা শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর মনোনিবেশ করে ধ্যান।
মহাযান অনুশীলনের মূল লক্ষ্য হল বোধিসত্ত্বের পথ অবলম্বন করে অন্তিম প্রাপ্তি, বুদ্ধত্ত্ব লাভ করা। ধ্যান বা ভাবনা হল মহাযান ধারার পারমীগুলোর একটি যা বুদ্ধত্ত্ব লাভের জন্য অপরিহার্য। ভারতীয় মহাযান ধারা বৌদ্ধিক ধারা, বৌদ্ধিক তত্ত্ব, মতবাদ ও ধ্যানের পদ্ধতির উপর কেন্দ্র করে বিকাশ হয়েছে। মহাযান ধারার এক এক উপধারার পন্থীগণ এক এক মতবাদ ধারণ করে থাকে। বিভিন্ন লিখিত উৎস থেকে দেখা যায়, সর্বাস্তিবাদ ধারার মত মহাযান ধারার পন্থীরাও উত্তর ভারত ও মধ্য এশিয়ায়, একই ধরনের ধ্যান বা ভাবনার অনুশীলন করে থাকে। এই ধারাতেও যোগাচারভূমি-শাস্ত্র গ্রন্থটির প্রভাব দেখা যায়, যেখানে ধ্যান বা ভাবনার তাত্ত্বিক আলোচনা করা হয়েছে। [১১]
এই ধারার ধ্যানে বিপাসনা ও শমথ, দুই ধরনের ধ্যানই অনুশীলন করা হয়। ভারতীয় মহাযান ধারায় যোগাচার আসাঙ্গা-এর অভিধর্মসমুচ্চ, বসুবন্ধু-এর মধ্যন্তবিভঙ্গ-ভাষ্য, স্মৃতি, ৩৭ রকমের বোধিপক্ষীয় ধর্ম ( চার স্মৃতিপ্রস্থান, চার সাম্মাপ্পাধানা , চার ঋদ্ধিপাদ, পঞ্চ ইন্দ্রিয়, পঞ্চ বালা, নির্বানের সাতটি বিষয়, অষ্টাঙ্গিক মার্গ), এবং সমাধির উপর ভিত্তি করে এর বিকাশ ঘটেছে। মহাযান ধারায় মহারত্নকুট সূত্র, প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র, অষ্টসংস্কারিক প্রজ্ঞাপারমিতা সহ বিভিন্ন সূত্র রয়েছে যার মূল বিশ্লেষণ হল ধ্যান বা ভাবনা। [১২]
মহাযান ধারার আরেক ধরনের ধ্যান অনুশীলন হল পদ্ম সূত্র, হৃদয় সূত্রের মতও বিভিন্ন সূত্র ও গাঁথা আবৃতির মাধ্যমে ধ্যান করা। এই আবৃতির এক বিশ্বাস হল, এর জপের ফলে অশুভ শক্তি দূরীভূত হয় এবং শুভ শক্তির আহরণ হয়। [১৩][১৪]
চৈনিক বৌদ্ধ ধর্মের ভাবধারাটি মধ্য এশীয় অঞ্চল থেকে বিকাশিত হলেও তা ভারতীয় মহাযান পন্থা থেকে খুব একটা আলাদা নয়। প্রখ্যাত চৈনিক অনুবাদক, ’’আন শিগাও’’ দ্বিতীয় শতাব্দীর দিকে আনাপানা স্মৃতি বা শ্বাস-প্রশ্বাসকে কেন্দ্র করে যে ভাবনা বা ধ্যান করা হয়, তার অনুবাদ করেন যা চৈনিক বৌদ্ধ ধর্ম ধারায় ধ্যানের জন্য ব্যবহৃত হয়ে এসেছে।[১৫] আরেক প্রখ্যাত চৈনিক অনুবাদক এবং শিক্ষাবিদ, ’’কুমারাজিভা’’ চতুর্থ শতাব্দীর দিকে ধ্যান সংক্রান্তিয় বিভিন্ন বিষয়ের অনুবাদ করেন এবং তা ’’বসে থেকে সমাধি অনুশীলনের সূত্রবলী’’ নামে গ্রন্থিত হয়, যা সর্বাস্তিবাদদের ধ্যানধারার সরাসরি প্রতিফলন। তাঁরা এই সকল সূত্রাবলীকে ধ্যান সূত্র বলে থাকে।[১৬] এই ধারায় সর্বাস্তিবাদের সৌত্রান্তিক ধারা এবং মহাযান ধারার প্রতিফলন দেখা যায়।[১৭]
পূর্ব এশিয়ায় যোগাচার ধারা বা ওয়েইশি ঝং চৈনিক বৌদ্ধ ধারার মাধ্যমে প্রভাবিত, যা জাপানে হাস্সো ধারা বলে পরিচিত। এই ধারায় বেশ কয়েক ধরনের ধ্যান বা ভাবনার অনুশীলন করা হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, এই ধারার ধ্যানীগণ এক শ্রেণীর চিত্র মনস্থ করে ধ্যান অনুশীলন করে থাকে, যার মধ্যে মৈত্রেয় বুদ্ধের বোধিসত্ত্বকে কেন্দ্র করে চর্চা করা হয়। যোগাচার সিদ্ধ, ঝুয়াংজ্যাং, এই ধরনের ধ্যানের কথা তাঁর জীবনী গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এই ধারার ধ্যানের মূল উদ্দ্যেশ্য হল পুনর্জন্ম লাভ করে মৈত্রেয় বুদ্ধের সান্নিধ্য লাভ করা এবং তাঁর শিষ্যত্ব লাভ করা।
চৈনিক ধ্যান ধারার আরেকটি রূপ হল '’বিজ্ঞাপ্তি মন্ত্র'’ জপের মাধ্যমে অনুশীলন করা, যা ঝুয়াংজ্যাং এর শিষ্য কুইজি প্রচলন ঘটান এবং এর প্রসার করেন। যোগাচার ধারার মধ্যে এর প্রভাব বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই ধারায় পাঁচটি স্তর রয়েছে:[১৮]
১) মিথ্যার অবদমন এবং সত্যের উন্মোচন,
২) পাপের মোচন এবং পুণ্যের সঞ্চয়,
৩) মূল উৎসে ফিরে যাওয়া,
৪) অধীনতা থেকে মুক্তি, এবং
৫) সকল কিছুর বাস্তব রূপ উপলব্ধি করা।
চায়নাতে নিয়মতান্ত্রিক ও বোধগম্য ধ্যান, তিয়ানতাই ধারাতে দেখা যায়। ভারতীয় বৌদ্ধ ধ্যান সংক্রান্তিয় নির্দেশিকা পুস্তক ছাড়াও এই ধারায় তাঁদের নিজেদের প্রবর্তিত কিছু ধ্যান অনুশীলন দেখা যায়, যা শমথ ও বিদর্শন ধ্যানের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। ঝিয়ি-এর সামাথাবিপাসানা, ঝিগুয়াং-এর মাহাসামাথাবিপাসানা, এবং ছয় সূক্ষ্ম ধর্ম দ্বার গ্রন্থ সমূহ, এই ধারার ধ্যানের জন্য বিশদভাবে পাঠ করা হয়ে থাকে। ঝিয়ি তাঁর গ্রন্থে বলেছেন "শমথ ও বিদর্শন অনুশীলনের মাধ্যমে নির্বান অর্জন করা সম্ভব। সকল বন্ধন একত্রিত করার প্রথম ধাপ হল শমথ, এবং বিদর্শন জাগতিক ভ্রান্তি দূর করার জন্য অপরিহার্য। শমথ ধ্যান মনের খোরাক মেটায়, এবং বিদর্শন আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটায়। শমথ ধ্যানের মাধ্যমে অনুপম সমাধির উৎপন্ন হয়, এবং বিদর্শন প্রজ্ঞা উৎপন্ন করে।" [১৯]
তিয়ানতাই ধারার ধ্যানে আনাপানা স্মৃতির প্রাধান্য দেখা যায়। ঝিয়ি শ্বাসকে চার ভাবে ভাগ : হাঁপানো, সাধারণ শ্বাস, নিঃশব্দের গভীর শ্বাস, এবং স্থবিরতা/বিশ্রাম। ঝিয়ির মতে, প্রথম তিন প্রকারের শ্বাস শুদ্ধ নয়, শুধুমাত্র চতুর্থ প্রকারের শ্বাসই শুদ্ধ। ঝিয়ি, চার রকমের সমাধি এবং দশ ধরনের বিদর্শনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
এন্নিন (জিকাকু দাইশি), জাপানই তেন্দাই ধারায় মিক্ক্যো বা নিদর্শন ধারার প্রচলন আনেন, যা পরবর্তীতে তামিৎসু বলে পরিচিতি লাভ করে। তেন্দাই তামিৎসু মতবাদ অনুযায়ী পদ্ম সূত্রের পাশাপাশি বিদর্শন ধ্যানও গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে, মন্ত্র জপ করে, নির্দিষ্ট মুদ্রাতে(ধ্যান আসন), বিদর্শন ধ্যানের মাধ্যমেই নির্বান লাভ করা সম্ভব। তিমিৎসু ধারার উৎপত্তি চীন থেকে, এবং কুকাই (কোবো দাইশি) ধারা থেকে এর ব্যপ্তি ঘটে।[২০]
হুয়ান মতবাদ ছিল চীনা বৌদ্ধধর্মের প্রধান মতবাদগুলোর একটি, যা চ্যান বৌদ্ধধর্মকেও দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাদের ধ্যান তত্ত্ব এবং অনুশীলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল "চতুর্গুণ ধর্মধাতু", যাকে সিফাজি (四法界) বলা হয়।[২১] ধর্মধাতু (法界) হল বোধিসত্ত্বের অনুশীলনের লক্ষ্য, বাস্তবতার চূড়ান্ত প্রকৃতি বা গভীরতম সত্য যা অবশ্যই ধ্যানের মাধ্যমে জানা এবং উপলব্ধি করতে হবে। চতুর্গুণ ধর্মধাতু হল "বিশ্বের চারটি জ্ঞানীয় পন্থা, বাস্তবতা ধরার চারটি উপায়"।[২১] হুয়ান মেডিটেশন বলতে বোঝানো হয়েছে এই চারটি "একটি অভূতপূর্ব বহুগুণে ক্রমবর্ধমানভাবে বেশি হলোগ্রাফিক দৃষ্টিভঙ্গির" মধ্য দিয়ে ক্রমবর্ধমানভাবে আরোহণ করা।[২১][২২]
বাস্তবতা দেখার বা জানার এই চারটি উপায় হল:
শুদ্ধ ভূমি বুদ্ধবাদ মূলত মহাযান বৌদ্ধধর্মের একটি বিস্তৃত শাখা এই ধারাটি শুদ্ধ ভূমি বা বুদ্ধ ক্ষেত্রে পুনর্জন্মের উপর জোর দেয়। শুদ্ধ ভূমি বুদ্ধবাদে মূলত বিদর্শন ধ্যান ধারা অনুশীলন করে থাকে। চীন, জাপান এবং কোরিয়াতে এর প্রচলন দেখা যায়। চৈনিক বৌদ্ধ ধর্মে এই ধারাকে প্রাতষ্ঠানিক অর্থে জোং (মৎ সম্প্রদায়) বলা হলেও ঐতিহাসিকভাবে বৌদ্ধ অনুশীলনের একটি পদ্ধতি উল্লেখ করে একটি "ধর্ম-দ্বার" (fǎmén 法門 ফ়া মেন্) হিসাবে বর্ণনা করা হয়। বৌদ্ধধর্মের জাপানি মতবাদ অনুযায়ী এই শব্দটি দিয়ে নির্দিষ্ট ধর্ম প্রতিষ্ঠানকে বোঝানো হয়।